লেখক : ড: সূর্য শেখর পাঠক
'আমার কলম দিয়ে আমি এমন একজন মানুষের কথা লিখছি যিনি অনন্য অসাধারন হয়েও ভারতবর্ষের সাধারন মানুষের জন্য নিজেকে একজন অতিসাধারন মানুষ হিসেবে আমাদের কাছে প্রস্তুত করেছিলেন । ---- তাঁর বত্তৃতার মধ্যে আমরা দেখেছি ক্রোধের অগ্নিজ্বালা আর বেদনার অশ্রুজল যেন একটি মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। বেদনার অশ্রুজল তাঁর মাতৃভূমির দুরবস্থার জন্য এবং ক্রোধের অগ্নিজ্বালা তাদের বিরুদ্ধে যারা এই দুরবস্থার জন্য দায়ী । ক্রোধের অগ্নিজ্বালা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে।'
মুক্তরূপ স্বামী বিবকানন্দ সম্পর্কে উপরোক্ত মন্তব্যটি প্রকাশ করেছিলেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রীক ভাষা সাহিত্যের প্রখ্যাত অধ্যাপক প্রবর জন হেনরী রাইটের সহধর্মিনী শ্রীমতী মেরী টাপ্পান রাইট ।
অশিক্ষা, কুশিক্ষা, অন্ধবিশ্বাস ও দরিদ্র জর্জরিত পরাধীনতার অক্টোপাশে আবদ্ধ ভারতমাতার জন্য বিবেকানন্দের ভাবনার অন্ত ছিল না। কীভাবে মাতৃভূমির উত্থান এবং দেশবাসীর কল্যাণ সাধন করা সম্ভব, এটিই ছিল তাঁর নিদ্রার স্বপ্ন, জাগরণে ধ্যান । বিশ্ব মাঝারে জন্মভূমিকে যথাযথ মর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠিত করবার কামনায় যখন বিবেকানন্দ অধীর হয়ে উঠেছিলেন তখন কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের চারশ বছর পূর্তি উৎসব উপলক্ষে শিকাগোতে বিশ্বধর্ম সম্মেলনের সংবাদটি তাঁর কর্নগোচর হয়েছিল ।
স্বামীজি হয়তো এমনি একটি বিশাল মঞ্চের কথা নিজের মনে মনে ভেবে চলেছিলেন যেখান থেকে ভারতবর্ষের প্রকৃত পরিচয় বিশ্ববাসীকে অবগত করিয়ে দেওয়া যেতে পারে এবং তাই অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে সুযোগের সদব্যবহার করবার উদ্দেশ্যে আমেরিকা পাড়ি দেবার অসাধারন সিদ্ধান্তটি তিনি নিয়ে বসেন ।
১৮৯৩ সালের ৩১ শে মে স্বামীজী ভারতীয় অধ্যাত্মবাদের অস্ত্র হাতে নিয়ে তাঁর দিগ্বিজয়ী অভিযান শুরু করে দেন । বম্বে থেকে সিংহল, সিঙ্গাপুর, হংকং ও জাপান হয়ে ১৮৯৩ সালের ২৫ শে জুলাই মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাত টায় তিনি ক্যা প্যাসিফিক লাইনের ছ' হাজার টনের জাহাজ ' এম্প্রেস অফ ইন্ডিয়া ' থেকে কানাডার ব্যাঙকুবার বন্দরে অবতরন করেন । সেরাত্রি বাঙ্কুবার রেলস্টশনের প্লাটফর্মে রাত্রি যাপন করে পরদিবস সকাল থেকে দীর্ঘ রেলযাত্রা অর্থাৎ পরপর তিনটি ট্রেন বদল করে ৩০শে জুলাই রবিবার রাত্রি এগারোটা নাগাদ স্বামীজী তাঁর গন্তব্যের লক্ষ্যস্থল শিকাগোতে উপনীত হন।
১৮৯৩ সালে ১১- ই সেপ্টেম্বর শিকাগোর নবনির্মিত ' আর্ট ইনস্টিটিউট ' - এর ' হল অব কলম্বাস ' - এ বিশ্বের প্রধান দশটি ধর্ম - ইহুদি, মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, ভাত্ত, কনফুসিয়াস, শিন্ট, পারসি, ক্যাথলিক ও খৃষ্টধর্ম নিয়ে যে বিশ্বধর্ম সভা হয়েছিল সেই মঞ্চে বিবেকানন্দ দেবী সরস্বতী ও গুরুদেব রামকৃষ্ণকে স্মরন করে জলদ গম্ভীর স্বরে যে ভাষণটি দিয়েছিলেন সেই ভাষনটিই তাঁকে বিশ্ববিখ্যাত করে দিয়েছিল । মস্তকে গৌরীয় পাগড়ি, গেরুয়া বস্ত্র পরিহিত দিব্যজ্যোতির মাত্র ত্রিশ বছরের যুবক স্বামীজী যখন সরল ভারতীয় সম্বোধনে আমেরিকাবাসীগনকে ' ভগিনী ও ভ্রাতা ' ( সিস্টার্স অ্যান্ড ব্রাদার্স অফ আমেরিকা ) বলে সম্ভাষণ জানালেন এবং জগৎকে আপন পরিবার বলে ঘোষণা করলেন তখন সেই মহাসম্মেলনে খুশির বন্যা বয়ে গিয়েছিল । আমেরিকার ছ' সাত হাজার বিশিষ্ট নাগরিক সেদিন এরূপ অভিনব সম্বোধন শুনে ( কারন এতদিন পর্যন্ত তাদের কান ' লেডিস অ্যান্ড জেন্টল মেনস ' শুনতে অভ্যস্ত ছিল ) আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছিল । বিবেকানন্দের কথায় অভিনবত্ব ও আন্তরিকতা দেখে শ্রোতারা দু ' মিনিট ধরে হর্ষধ্বনি দিয়ে সভামণ্ডপ মুখরিত করে রেখেছিলেন ।
সভাকক্ষ শান্ত হলে স্বামীজী জগৎবাসীকে শুনিয়েছিলেন ভারতের সমন্বয় বার্তা । তিনি বলেছিলেন, ' যে ধর্ম জগৎ কে পরধর্মের প্রতি উদার ও সব মতকে স্বকৃতি দান করতে শিখিয়েছে, আমি সেই ধর্মভূক্ত বলে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি । সহিষ্ণুতা ও সর্বজনীন উদারতাই আমার আদর্শ। ' বিবেকানন্দ সেদিন যে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিয়েছিলেন এক কথায় তা হচ্ছে শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণের বিখ্যাত বাণী - ' যত মত , তত পথ।'
শিকাগোর মহাধর্ম সম্মেলনের মঞ্চটি ছিল স্বামীজীর বিশ্বজয়ের প্রথম পদক্ষেপ । এই মঞ্চে থেকে ভারতের সমন্বয়বার্তা জগৎবাসীকে শুনিয়ে স্বামীজী রাতারাতি আমেরিকাবাসীর চিত্ত জয় করে নিয়েছিলেন । সম্মেলন মোট সতেরো দিন ধরে চলেছিল, যাতে স্বামীজী বারটি বক্তৃতা রেখেছিলেন । হিন্দু ধর্ম সম্বন্ধে ১৯ সেপ্টেম্বর স্বামীজীর লিখিত ভাষণটি সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়েছিল । এই লিখিত বক্তব্যটি বিবেকানন্দের মৌলিক চিন্তা এবং উদার মানসিকতার পরিচয় বহন করে। তিনি অধিবেশনের শেষদিন যে কথাগুলি বলেছিলেন তা আজকের দিনেও খুবই প্রাসঙ্গিক ।
১৮৯৩ সালের নভেম্বর থেকে শুরু করে বিবেকানন্দ কয়েক মাস আমেরিকার পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলের অনেকগুলি শহরে বক্তৃতা দিয়েছিলেন । এই বক্তৃতার মাধ্যমে তিনি আমেরিকাবাসীর কাছে ভারতের ধর্ম, সংস্কৃতি ও সমাজের যথার্থ চিত্র তুলে ধরতে সচেষ্ট হন।
১৮৯৩ সালে স্বামীজী জনৈক ভক্তের আমন্ত্রন- এ নিউইয়র্ক শহর থেকে দু ' শ মাইল দূরে লরেন্স নদীর মধ্যে ' থাইল্যান্ড আইল্যান্ড পার্ক ' - এ যান এবং সেখানে সাত সপ্তাহ কাটিয়ে আসেন । এই দ্বীপে তিনি শিষ্য দের যে সমস্ত উপদেশ প্রদান করেছিলেন সেই সমস্ত উপদেশাবালী মিস ওয়ালডো লিখে রেখেছিলেন । যেটি পরবর্তী সময়ে ' ইন্সপায়ারড টকস ' নামে বই - এর আকারে প্রকাশিত হয়েছিল ।
দু' বছর একটানা আমেরিকায় বেদান্ত প্রচারের পর ১৮৯৫ সালের আগস্টে স্বামীজী ইউরোপ যাত্রা করেন । প্যারিস হয়ে তিনি লন্ডনে পৌঁছান। সেখানে গিয়েই তাঁর নিয়মিত ক্লাস ও বক্তৃতা শুরু হয়েছিল । আমেরিকার মতো লন্ডনেও স্বামীজীর খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ' লন্ডন ডেলি ক্রনিকল ' সে সময় লিখেছিল, ' স্বামী বিবেকানন্দকে দেখলেই বুদ্ধের কথা মনে হয় ।' মিস মার্গারেট নোবল এখানেই তাঁর সংস্পর্শে এসে শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন । পরে ভারতে ফিরে স্বামীজী এঁকে ব্রহ্মচর্যব্রতে দীক্ষিত করে নাম দেন ভগিনী নিবেদিতা।
স্বামীজী ছিলেন ভারতের নবজাগরনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পথিকৃৎ। মানবসমাজের কল্যাণের জন্য এবং ভবিষ্য ৎ মানবজাতির অভ্রান্ত পথ নির্দেশকরূপেই তাঁর আবির্ভাব।স্বদেশের দুঃখ দুর্দশার প্রতিকারের জন্য যে বিদেশের সাহায্য নেওয়া আবশ্যক একথা বিবেকানন্দ জানতেন । কিন্তু ' দেহি দেহি ' মনোভাব নিয়ে ভিক্ষার ঝুলি হাতে তিনি পাশ্চাত্যে যাননি। পাশ্চাত্য থেকে কিছু নেওয়ার বিনিময়ে তিনি তাদের দিতে চেয়েছিলেন ভারতীয় আধ্যাত্মিকতা, শান্তি, মৈত্রী ও সমন্বয়ের বাণী। কেবলমাত্র প্রাচ্যভূমিকেই নয়, সম্পূর্ণ বিশ্ববাসীকে স্বামীজী পথ নির্দেশ দিয়েছিলেন । এমনকি ভোগ বিলাসের জগতে ইউরোপ - আমেরিকাও বিবেকানন্দের উপদেশ নির্দেশে নতুন আলোর সন্ধান পেয়েছিল । বিশ্বমাঝারে ভারতের বিজয় কেতন উত্তোলন করে যখন ১৮৯৭ সালে স্বামীজী স্বদেশে ফিরে এলেন তখন সমস্ত দেশ তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাতে উন্মত্ত হয়ে যায় । (সংক্ষেপিত)