কলকাতা, ৪ অক্টোবর : “দাদা, কাল আমাদের জীবনের বিজয়া দশমী। ঐদিন আপনাদের এবং প্রিয় জন্মভূমিকে ছেড়ে চলে যেতে হবে। ....কে সাবধানে থাকতে বলবেন। তার উপর বিশেষ কোপদৃষ্টি। যাবার আগে মাতৃভূমির স্বাধীনতা কামনা করে যাব। যদি এ ব্রত অসমাপ্ত থেকে যায়, প্রার্থনা করব আবার যেন এই দেশে জন্মগ্রহণ করি এবং ব্রত উদযাপন করি।” কবেকার চিঠি জানেন? ১৯১৫-র ১১ নভেম্বর নীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত এবং মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত এই চিঠি লিখেছিলেন। ১৯১৫-র ৯ সেপ্টেম্বর বুড়িবালামের তীরে যতীন মুখার্জির নেতৃত্বে যে পঞ্চবীর অসম সাহসে ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন, তাঁদের তিন জন লড়াইয়ে মারা যান। আত্মসমর্পনে বাধ্য হন ওই দুই দামাল বঙ্গসন্তান। ফাঁসি হয় তাঁদের। তার আগের দিন, লিখলেন ওই চিঠি। অথচ নিজেদের কোনও উদ্বেগ নেই। তাঁদের তখনও চিন্তা কী করে সংগঠন রক্ষা করা যায়, যাতে অচিরেই দেশ স্বাধীন হয়। কী মহাপ্রাণ!
নীরেন্দ্রনাথ, মনোরঞ্জনের নাম আজ আমরা ক’জন মনে রেখেছি? যেমন অনেকেই মনে রাখিনি ইন্দুভূষণ রায়কে। ১৯০৮ সালের ২ মে মানিকতলার ৩২ মুরারিপুকুর রোডে গোপন ডেরা থেকে ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করেছিল আলিপুর বোমা মামলার আসামী করে। ১৯০৯ সালের ১১ ডিসেম্বর তাঁকে আন্দামানে পাঠানো হয়। অপরিসীম অত্যাচার ও পরিশ্রমে তাঁর প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে। তাঁকে রম্বাস নামের গুল্ম থেকে সাদা শন উদ্ধার করার কাজ দেওয়া হয়েছিল। গুল্মের রস হাতে লেগে ফোস্কা, তা থেকে দগদগে ঘা হয়ে যায়। ১৯১২ সালের ২৮ এপ্রিল কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করেন জেলে অন্য কোনও হালকা কাজ দিতে। কিন্তু উল্টে তাঁকে শায়েস্তা এমন কাজ দেওয়া হল, যেটা তাঁর পক্ষে অসম্ভব। পরদিন তাঁকে তাঁর কুঠুরির জানলার গরাদ থেকে মৃত ঝুলতে দেখা যায়। অসম্ভব যন্ত্রনার মধ্যেই ক্ষতবিক্ষত হাতে নিজের পরনের জামা ছিঁড়ে ফালি করে জুড়ে জুড়ে দড়ি তৈরি করেছিলেন ইন্দু।
বা, ধরা যাক সুশীল সেনের কথা। ১৯০৭ সালে। আলিপুর কোর্টে কিংসফোর্ডের এজলাসে আলিপুর বোমা মামলার শুনানী চলার সময় লাঠি চালিয়ে সমবেতদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা হয়। সেই সময় ১৫ বছরের সুশীল ‘বন্দেমাতরম’ বলে পুলিশকে মারতে ওঠে। পুলিশ তাকে ধরে কিংসফোর্ডের নির্দেশে ১৫ বার বেত্রাঘাত করে। ১৯১৫-র ২ মে কিছু বিপ্লবী একটি পরিত্যক্ত গোয়ালঘরে রান্না করছিলেন। সন্দেহ হওয়ায় গ্রামবাসীরা পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ ঘটনাস্থলে যেতেই জলপথে পালানোর চেষ্টা করেন বিপ্লবীরা। গুলিতে গুরুতর আহত হন সুশীল। তাঁদের নৌকো ধাওয়া করে পুলিশ। সবার ধরা পড়ে যাওয়ার উপক্রম! সুশীল মৃত্যু আসন্ন বুঝে সঙ্গীদের ঝুঁকি এড়াতে তাঁর গলা আর ধর কেটে ফেলতে বলেন। বলেন, একটা ভাগ জলে ফেলে দিলে তাঁকে পুলিশ সনাক্তই পারবে না। বাকিরা বেঁচে যাবে। সঙ্গীরা সেটাই করলেন।
বিপ্লবীদের এরকম নানা অ্যাডভেঞ্চার-সম ইতিহাসের কাহিনী দিয়ে মালা গেঁথেছেন স্বাধীনতা সংগ্রামের গবেষক শিবশঙ্কর ঘোষ তাঁর ‘স্বাধীনতা সংগ্রামের কিছু অজানা কথা’ বইয়ে। দেড়-দু পাতার এক একটা কাহিনী। শিরোনামগুলিও সুন্দর— ঘরশত্রুর বিনাশ (চারুচন্দ্র বসু), কিশোরের নরকদর্শন (ইন্দুভূষণ রায়), বাঘশিকারী বিপ্লবী (যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যয়), বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা (ভগবতীচরণ), দার্শনিক বিপ্লবী (প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য) প্রভৃতি। এতে আছে বিরাশিটা গল্পে মোট একশো আটচল্লিশ জন বিপ্লবীদের কথা। এদের মধ্যে বাহাত্তর জন হলেন ফাঁসির শহীদ। এই বাহাত্তর জনের মধ্যে তেত্রিশ জন অবাঙালি এবং উনচল্লিশ জন বাঙালী। বইয়ের শেষের দিকে একটি ছাপা তালিকা আছে। তাতে সমস্ত ফাঁসির শহীদের নাম পাওয়া যাবে। এঁদের সবাইকার কথা কিন্তু ওই বিরাশিটা গল্পে নেই। বিরাশিটা গল্পের খবর বইয়ের সঙ্গে দেওয়া হাতে লেখা একটি তালিকা থেকে পাওয়া যাবে। প্রকাশিত বইটিতে সূচিপত্রের মধ্যে আছে ওই আলাদা একপাতা জেরক্স কাগজ (হাতে লেখা)। সেটা দেখলেই সব বোঝা যাবে।
বইটা পড়তে গিয়ে মনে পড়ছিল কবি ও ব্যাকরণবিদ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কথা। তিনি লিখেছিলেন, “ভাষা সরল হবে, কিন্তু তরল হবে না। উচ্ছাস বা কাব্যিকতা পরিহার্য। উচ্ছাস ভাষাকে আবিল করে। কাব্যিকতাকে প্রশ্রয় দিলে গদ্যভাষা এলিয়ে যায়। ... কঠিন শব্দ পরিহার করুন। শার্দুলের গর্জনের চেয়ে বাঘের হালুম কিছু কম ভয়ঙ্কর নয়। কঠিন ভাষা ব্যবহার করবেন না। জার্গন পাঠককে দূরে ঠেলে দেয়” (‘বাংলা কী লিখবেন, কেন লিখবেন’)। এককালের নামী সংস্থার প্রতিষ্ঠিত ইঞ্জিনিয়ার, সুলেখক শিবশঙ্কর ঘোষের এই বই যেন প্রয়াত কবির সুপারিশের আদর্শ প্রতিফলন। আর তাই ৮ থেকে ৮০— প্রায় সবাই পছন্দ করবেন ৮৩ বছরের যুবকের ‘স্বাধীনতা সংগ্রামের কিছু অজানা কথা’। শয়নে-স্বপনে ভারতের স্বাধীনতার স্মৃতিকে জড়িয়ে সুস্থভাবে দীর্ঘায়ু হোন শিবশঙ্করবাবু। একের পর এক এরকম বই উপহার দিন পাঠকদের।