দুরন্তবার্তা ডিজিটাল ডেস্ক : যারা জানেন মদ্যপান শরীরের জন্য ক্ষতিকর, তারাও অনেক সময় হৃদয়ের আহ্বানে হার মানেন। বৃষ্টির দিনের স্নিগ্ধ রোম্যান্টিকতায় এক ফোঁটা মদ না থাকলে যেন অনুভবটাই অপূর্ণ থেকে যায়। আর তীব্র গরমের দিনে ঠান্ডা বিয়ারের গ্লাসে প্রথম চুমুক – এই স্বাদ যে একবার পেয়েছে, সেই জানে এর তৃপ্তি ঠিক কতটা গভীর। অনেকে বলেন, জীবনের ছোট ছোট আনন্দেই তো বেঁচে থাকার মানে খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু সেই আনন্দ যদি শরীরের ক্ষতির কারণ হয়, তখনই প্রশ্ন ওঠে—এই স্বস্তি কি দীর্ঘস্থায়ী, নাকি তা এক মায়াবী ফাঁদ?
যুক্তি, পাল্টা যুক্তি যতই থাকুক, ছিপছিপে, নির্মেদ শরীর ধরে রাখতে হলে কিন্তু মদ্যপানে রাশ টানতেই হবে বলছেন পুষ্টিবিদ। সুরাপানে যে ওজন বাড়ে, প্রমাণ মিলেছে গবেষণাতেও। কিন্তু কেন? অ্যালকোহল তো পানীয় বৈ আর কিছু নয়!
পুষ্টিবিদ অনন্যা ভৌমিক বলছেন, ‘‘অ্যালকোহলে প্রচুর ক্যালোরি রয়েছে। অথচ পুষ্টিগুণ শূন্য। এ পানীয়ে উপকার নেই কোনও, বরং ক্ষতি বেশি। সেই কারণেই মদ খেলে ওজন বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ করা যায়।’’
কোন সুরায় কত ক্যালোরি?
• ১ গ্রাম অ্যালকোহলে মেলে ৭ ক্যালোরি।
• ৩৫০ মিলিলিটার বিয়ারে ১৫০ কিলোক্যালোরি।
• ৪৫ মিলিলিটার হুইস্কিতে থাকে ১০০ কিলোক্যালোরি।
• ককটেলে ২০০-৩০০ কিলোক্যালোরি
• ১৫০ মিলিলিটার ওয়াইন খেলে মিলবে ১২০ কিলোক্যালোরি।
২০১০ সালে ‘ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ মেডিসিন’-এর জার্নালে প্রকাশিত একটি সমীক্ষার ফলাফল বলছে, অ্যালকোহল পানে শুধু ওজন নয়, স্থূলত্বের মতো অসুখের প্রবণতাও বেড়ে যায়। সমীক্ষাটি করা হয়েছিল মধ্যবয়স্ক মহিলাদের উপর। দীর্ঘ সময় ধরে মদ্যপানের ফলে তাঁদের ওজন বেড়েছিল অনেকটাই। অনেকে স্থূলত্বের মতো অসুখের শিকারও হয়েছিলেন। এই সমীক্ষা এবং গবেষণা জানায়, অনিয়ন্ত্রিত এবং দিনের পর দিন মদ্যপান স্থূলত্বের অন্যতম কারণ।
কিন্তু কেন বেড়ে যায় ওজন?
ফ্যাট বিপাক: অ্যালকোহল বা মদ্যপান শরীরের ভিতরের কাজকর্ম, বিশেষ করে বিপাকক্রিয়া (মেটাবলিজম) আর হরমোনের ভারসাম্যে প্রভাব ফেলে। এর ফলেই অনেকের ওজন বাড়তে থাকে। আমাদের প্রতিদিনের খাবার ঠিকভাবে হজম হতে হলে শরীরের বিপাকহার ঠিক থাকা জরুরি। কারও ওজন বাড়বে না কমবে, সেটা অনেকটাই নির্ভর করে এই বিপাকহারের উপর।অ্যালকোহল শরীরে যাওয়া মানে বাড়তি ক্যালোরি ঢোকা। অথচ এটি ফ্যাট বিপাকে বাধা সৃষ্টি করে, যার ফলে দ্রুত ওজন বেড়ে যায়। বিশেষত মেদ জমতে থাকে পেটে। বেড়ে যায় ভুঁড়ি।
খিদে বৃদ্ধি করে: যখন অ্যালকোহল শরীরে ঢোকে, তখন ধীরে ধীরে একজন মানুষ নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করেন। অনেক সময় মদ্যপানের পর ফ্যাটযুক্ত, নোনতা বা মিষ্টি খাবার খাওয়ার ইচ্ছা বেড়ে যায়।এই খিদে ও খাওয়ার পরের তৃপ্তি মূলত নিয়ন্ত্রণ করে লেপটিন আর ঘ্রেলিন নামের দুটি হরমোন। কিন্তু অ্যালকোহল এই হরমোনের স্বাভাবিক ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়। ফলে না চাইতেও অতিরিক্ত খাওয়া হয়ে যায়, যা ওজন বাড়ানোর আর একটা বড় কারণ।
ঘুমে প্রভাব ফেলে: ঘুমের সঙ্গেও ওজনের সম্পর্ক থাকে। ফিটনেস প্রশিক্ষকেরা বলেন ওজন কমাতে হলে পর্যাপ্ত ঘুমের প্রয়োজন। অ্যালকোহল পানে স্ট্রেস হরমোন নামে পরিচিত কর্টিসলের ক্ষরণ বেড়ে যায়। ঘুমেও এর প্রভাব পড়ে। আলসেমি, ক্লান্তি বেড়ে যায়।
ফ্যাটি লিভার: নিয়মিত এবং অনিয়ন্ত্রিত মদ্যপানে লিভারে মেদ জমতে পারে। ফ্যাটি লিভার হলে ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং বিপাকহার ঠিক রাখা আরও কঠিন হয়ে পড়ে।
ওয়াইন নিয়ে একটা সাধারণ ধারণা রয়েছে—এটা নাকি শরীরের তেমন ক্ষতি করে না, আর ওজনও বাড়ায় না।পুষ্টিবিদেরা অবশ্য এ বক্তব্যে মোটেই সিলমোহর দিচ্ছেন না। তবে ‘নিউট্রিয়েন্টস’ জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র বলছে, ‘‘পরিমিত ওয়াইন পানে ওজন বশে রাখা যায়।" একই সঙ্গে গবেষণাপত্রেরই একটি অংশে উল্লিখিত, অনিয়ন্ত্রিত ওয়াইন ওজন বৃদ্ধির কারণ হতে পারে।
পুষ্টিবিদরা বলছেন, শরীরের ওজন বাড়া বা কমার পেছনে ক্যালোরি কতটা খাওয়া হচ্ছে, তার বড় ভূমিকা থাকে।সুতরাং কেউ যদি পরিমিত মদ্যপানে পান করেন বা মেপে খান, তা হলে ক্যালোরির পরিমাণ বশে রাখতে পারেন। গুরুত্বপূর্ণ হল মদ্যপানে রাশ টানা। পুষ্টিবিদ ভুবন রাস্তোগি ইনস্টাগ্রাম পোস্টে বলছেন, ‘‘পরিমিত মদ্যপানে ওজন বৃদ্ধি হয় না। অ্যালকোহলের ক্ষতিকর দিক থাকলেও ক্যালোরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ওজন বশে রাখা যায়।’’