দুরন্তবার্তা ডিজিটাল ডেস্ক: পাহাড়ের গায়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা গাছেরা যেন ছুঁয়ে ফেলতে চায় আকাশ। ঘন পাতার সবুজে ঢেকে থাকে গোটা এলাকা। পাইন আর ওকের মায়াজাল ঘেরা কুয়াশা-মেঘের রাজত্বে গড়ে ওঠে এক অপার্থিব সৌন্দর্য। সেই টানেই দার্জিলিং, কার্শিয়াং কিংবা কালিম্পং— বারবার ডাকে ভ্রমণপিপাসুদের। ঠান্ডা হাওয়া, বরফে মোড়া শৃঙ্গ, আর পাহাড়ি নীরবতার মধ্যেও এক রহস্যময় আমন্ত্রণ লুকিয়ে থাকে।
তবে হুট করেই তো আর কাজ ফেলে পাহাড়ের ডাকে সাড়া দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু তাই বলে সবুজের দেখা কি একমাত্র পাহাড়েই মেলে? মোটেই না। দক্ষিণবঙ্গেও আছে নিবিড় অরণ্য। শহরের গরম আর ধোঁয়াশা ছাড়িয়ে, একটু দূরেই মেলে সবুজের শান্ত পরশ। একদিনের একটু সময় পেলেই, ছুঁয়ে আসতে পারেন সেই সবুজ জগৎ— যেখানে গাছেরা কথা বলে বাতাসের সঙ্গে। রইল এমন ৫ টি জায়গার হদিস -
১)ভালকি মাচান -
পাইন বা ওকের জঙ্গল না থাকলেও, শাল আর পিয়ালের সবুজে ঘেরা এক শান্ত প্রকৃতি অপেক্ষা করে আছে আপনাকে জন্য। কলকাতা থেকে মাত্র তিন ঘণ্টার পথ বর্ধমানের আউশগ্রাম। এখানেই রয়েছে ‘ভালকির জঙ্গল’ নামে এক ঘন বনাঞ্চল, যার বুক চিরে চলে গিয়েছে কালো পিচের মসৃণ রাস্তা।
এই বনের মাঝেই এক সময় বর্ধমানের রাজারা বানিয়েছিলেন উঁচু একটি কাঠামো, দেখতে অনেকটা ওয়াচ টাওয়ারের মতো। শোনা যায়, এই মাচা থেকে রাজা ভালুক শিকার করতেন, আর সেই থেকেই জায়গার নাম হয় ‘ভালকি মাচান’। আজ সেই জায়গাই পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় এক ঠিকানা হয়ে উঠেছে।
বনের খুব কাছেই রয়েছে যমুনা দিঘি—প্রায় ২৫ হেক্টর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এক বড় জলাশয়, যেখানে রাজ্য মৎস্য দফতর মাছ চাষ করে। আর চাইলে ঘুরে আসতে পারেন পাশের টেরাকোটার মন্দির এবং ডোকরাপাড়াও, যেখানে আপনি দেখতে পাবেন হাতে তৈরি ডোকরা শিল্পকর্ম।
রাতটা কাটিয়ে দিতে পারেন বনভূমির মধ্যেই থাকা অতিথিশালায়, প্রকৃতির কোলে নিঃশব্দ আরাম পেতে
কী ভাবে যাবেন?
ভালকির জঙ্গলে পৌঁছনো একেবারেই কঠিন নয়। হাওড়া-বর্ধমান শাখার ট্রেনে চেপে আপনি সহজেই পৌঁছে যেতে পারেন মানকর স্টেশন পর্যন্ত। সেখান থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার পথ অটো বা গাড়ি ভাড়া করে পৌঁছে যেতে পারবেন অরণ্যের একেবারে কাছে।
যদি আপনি সড়কপথে যেতে চান, তবে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে এগিয়ে আসুন পারাজ পর্যন্ত। পারাজ থেকে ভালকির দূরত্ব প্রায় ১৩ কিলোমিটার। কলকাতা থেকে সরাসরি গাড়ি করেও যাত্রা করা যায় খুবই স্বাচ্ছন্দ্যে।
২)গড় মান্দারন
এক দিনের ছোট্ট ছুটিতে ইতিহাস আর প্রকৃতির ছোঁয়া পেতে চাইলে ঘুরে আসতে পারেন গড় মান্দারন থেকে—যেখানে জড়িয়ে রয়েছে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দুর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাসের পটভূমি। হুগলির আরামবাগ মহকুমায় অবস্থিত মান্দারন গ্রামেই রয়েছে এই ঐতিহাসিক গড়। এখন যদিও কেবল ধ্বংসাবশেষই চোখে পড়ে, তবু তার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে এক অন্যরকম সৌন্দর্য।
সবচেয়ে বেশি পর্যটক আসেন শীতকালে—এই সময় জায়গাটা রীতিমতো প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে পিকনিকপ্রেমীদের ভিড়ে। চারপাশে ছায়াঘেরা গাছগাছালি, কোথাও সাজানো বাগান, আবার কোথাও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রাকৃতিক জঙ্গল—এই দ্বৈত সৌন্দর্যই গড় মান্দারনকে করে তোলে এক অনন্য গন্তব্য।
বর্ষায় আবার বদলে যায় তার রূপ—সবুজের গাঢ় চাদরে ঢেকে যায় গোটা অঞ্চল। ইতিহাস, প্রকৃতি আর নির্জনতাকে একত্রে খুঁজে পেতে চাইলে গড় মান্দারন হতে পারে আপনার পরবর্তী গন্তব্য।
কী ভাবে যাবেন?
গড় মান্দারন পৌঁছনোর পথও বেশ সহজ। হাওড়া থেকে আরামবাগ বা গোঘাট লোকাল ট্রেনে চেপে চলে আসতে পারেন—দুই স্টেশন থেকেই গন্তব্যে যাওয়া যায়। বিশেষ করে গোঘাট স্টেশন থেকে গড় মান্দারনের দূরত্ব মাত্র ৮ কিলোমিটার। সেখান থেকে অটো বা গাড়ি করে সহজেই পৌঁছে যাবেন।
আর যদি ট্রেনে যেতে না চান, তবে কলকাতা থেকে সরাসরি গাড়িতে করেও পৌঁছনো যায় এই ঐতিহাসিক জায়গাটিতে, যা একদিনের সফরের জন্য আদর্শ।
৩)বেথুয়াডহরি অভয়ারণ্য-
শহরের ইট-কাঠের জঙ্গল ছেড়ে প্রকৃতির শান্ত কোলে সময় কাটাতে চাইলে বেথুয়াডহরি অভয়ারণ্য হতে পারে এক দারুণ ঠিকানা। নদিয়ার নাকাশিপাড়ায়, ১২ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে ৬৭ হেক্টর জমির উপর গড়ে উঠেছে এই সবুজ আশ্রয়স্থল।
অজস্র প্রাণীর বাসভূমি এটি—চিতল হরিণ, অজগর, গন্ধগোকুল, খটাশ-সহ আরও অনেক বন্যপ্রাণ এখানে নিশ্চিন্তে বিচরণ করে। অরণ্যের বুকজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে নানা রকম গাছগাছালি, আর তারই মধ্যে বাসা বেঁধেছে বহু প্রজাতির পাখি।
অরণ্য, তৃণভূমি আর জলাশয়ের সমন্বয়ে গঠিত এই অভয়ারণ্য ১৯৮০ সালে সরকারিভাবে অভয়ারণ্যের স্বীকৃতি পায়। প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য এটি এক নিঃসন্দেহে মনকাড়া গন্তব্য।
কী ভাবে যাবেন
বেথুয়াডহরি অভয়ারণ্যে পৌঁছনো একেবারেই সহজ। শিয়ালদহ থেকে লালগোলা প্যাসেঞ্জার ট্রেনে উঠে নেমে পড়ুন বেথুয়াডহরি স্টেশনে—সেখান থেকে অল্প পথ পেরোলেই অভয়ারণ্যের দুয়ার।
চাইলে বহরমপুরগামী বাস ধরেও পৌঁছে যেতে পারেন, বাস থেকে সরাসরি অভয়ারণ্যের সামনে নামা যায়। যারা রাত কাটাতে চান, তাঁদের জন্য এখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি বেসরকারি হোটেলের সুবিধা।
৪)বিভূতিভূষণ অভয়ারণ্য_
কলকাতা থেকে মাত্র ১১০ কিলোমিটার দূরেই অপেক্ষা করে এক নিঃশব্দ সবুজ জগৎ—পারমাদন। গাছগাছালিতে ঘেরা এই অরণ্যে হরিণের চলাফেরা আর অসংখ্য পাখির ডাক মিলে তৈরি হয়েছে এক অনন্য পরিবেশ। এখানেই রয়েছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে গড়া অভয়ারণ্য, যা প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে বিশেষ আকর্ষণ।
অরণ্যের ভিতরে রয়েছে একটি নজরমিনার—সেখান থেকে চোখ মেললেই দেখা যায় বিস্তৃত সবুজ আর বর্ষায় তার সৌন্দর্য হয়ে ওঠে আরও মায়াবী। পাশেই শান্তভাবে বয়ে চলেছে ইছামতী নদী। নদীর ওপারে মঙ্গলগঞ্জে দাঁড়িয়ে আছে ইংরেজ আমলের নীলকুঠি, যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস আর ভৌতিক কল্পনার রোমাঞ্চ।
অনেকে এখানে শুধু প্রকৃতির টানে আসেন, কেউ কেউ আবার নীলকুঠির রহস্যময়তায় খুঁজে ফেরেন অন্য রকম অভিজ্ঞতা। চাইলে ইছামতীর জলে নৌকায় ভেসে আরও কাছ থেকে উপভোগ করতে পারেন এই নিসর্গ। রাত্রিবাসের জন্য এখানে থাকার ব্যবস্থাও রয়েছে।
কী ভাবে যাবেন?
পারমাদন অভয়ারণ্যে পৌঁছতে চাইলে পথ একাধিক। কলকাতা থেকে গাড়িতে সরাসরি যাওয়া যায়—সময় লাগে আনুমানিক সাড়ে তিন থেকে চার ঘণ্টা।
ট্রেনে যাত্রা করতে চাইলে শিয়ালদহ থেকে বনগাঁ লোকাল ধরতে পারেন। বনগাঁ থেকে পারমাদনের দূরত্ব প্রায় ৩৩ কিলোমিটার। সেখান থেকে রিকশায় পৌঁছে যান মোটিগঞ্জ। মোটিগঞ্জ থেকে দত্তফুলিয়ার বাস ধরে নেমে পড়ুন নলডুগরি। এরপর টোটো বা রিকশায় খুব সহজেই পৌঁছে যাবেন বিভূতিভূষণ অভয়ারণ্যের প্রবেশপথে।
৫)খিসমা -
এক দিনের স্বল্প ভ্রমণে প্রকৃতির কাছাকাছি যেতে চাইলে নদিয়ার রানাঘাটের খিসমার জঙ্গল হতে পারে এক অনন্য গন্তব্য। তুলনামূলকভাবে ছোট এই বনভূমি মূলত পাখিপ্রেমীদের কাছে বেশ জনপ্রিয়।
বর্ষার দিনে সরু জঙ্গলপথ ধরে গাছগাছালির ছায়ায় হেঁটে বেড়ানোয় মেলে অন্যরকম শান্তি। প্রজাপতির রঙিন ঝাঁক আর নানা রকম পাখির ডাক এখানে প্রকৃতিকে যেন আরও জীবন্ত করে তোলে। লেসার হুইসলিং ডাক, রক পিজিয়ন, এশিয়ান ওপেনবিল—এমন অনেক বিরল ও পরিচিত প্রজাতির পাখি দেখা যায় এই জঙ্গলে।
প্রকৃতিপ্রেমী, বিশেষ করে বার্ডওয়াচারদের জন্য খিসমার এক মন ভোলানো ঠিকানা।
কী ভাবে যাবেন?
খিসমার জঙ্গলে পৌঁছনো বেশ সহজ। শিয়ালদহ থেকে গেদে শাখার লোকাল ট্রেনে উঠে নামতে হবে আড়ংঘাটা স্টেশনে। সেখান থেকে টোটো ভাড়া করলেই পৌঁছে যাবেন সবুজে ঘেরা খিসমার জঙ্গলে—যেখানে অপেক্ষা করছে পাখির কলকাকলি আর প্রাকৃতিক নিস্তব্ধতা।