কলকাতা, ৭ আগস্ট : শনিবার ভরসন্ধেয় পার্ক স্ট্রিটের কাছে ভারতীয় জাদুঘরে সিআইএসএফ-এর ব্যারাকে ঘটে যাওয়া শ্যুটআউট ঘিরে উঠে আসছে প্রশ্ন। কারণ, প্রাথমিকভাবে জানা গিয়েছে ঘাতক জওয়ান (হেড কনস্টেবল) ওড়িশার বাসিন্দা অক্ষয় কুমার মিশ্র এতবড় কাণ্ড ঘটিয়েছেন। তাঁর বন্দুকের গুলিতে মৃত্যু হয়েছে সিআইএসএফ-এর এএসআই রঞ্জিত কুমার সারেঙ্গির। দু’জনই ওড়িশার বাসিন্দা। দু’জনের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল বলে সূত্রের খবর। ছুটি বাতিল হওয়ায় অক্ষয় নাকি ক্ষুব্ধ ছিলেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের উপর। সেই ক্ষোভ থেকেই কি এলোপাথাড়ি গুলি সিআইএসএফ-এর ঘাতক জওয়ানের?
মাস তিনের আগেই, গত ১০ জুন পার্ক সার্কাসে বাংলাদেশ হাইকমিশনের কাছে ঘটেছিল এরকম একটা ঘটনা। কলকাতা পুলিসের এক জওয়ান ভরদুপুরে এভাবেই এলোপাথাড়ি গুলি চালানোয় মারা যান হাওড়ার বাসিন্দা এক তরুণী৷ তিনি কাজে যাচ্ছিলেন৷ পরে পুলিস কর্মী নিজের কপাল লক্ষ্য করে গুলি চালালে ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু ঘটে৷ বিতর্কের জেরে প্রশ্ন উঠেছিল সশস্ত্র রক্ষীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়মিত পরীক্ষা করা হচ্ছে কিনা। বন্দুকধারী রক্ষী কোথাও মোতায়েনের সময় বিভাগীয় কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে তাঁর ওপর কতটা আস্থা রাখতে পারেন, তার ওপর কর্তৃপক্ষের নজর রাখার কথা। সেটাও কি খতিয়ে দেখা হচ্ছে? এ ব্যাপারে মনোবিদদের সহায়তা নেওয়া হচ্ছে কতটা? জনাকীর্ণ কোনও জায়গায় এভাবে গুলি চালালে তো মারাত্মক বিপর্যয় ঘটে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা থাকে!
পুলিশের, বিশেষত বন্দুকধারীদের মানসিক স্বাস্থ্য যে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তা স্বীকার করেছেন পুলিশকর্তা অর্নব ঘোষ। চন্দননগরের পুলিশ কমিশনারের দায়িত্ব থেকে সম্প্রতি বদলি হয়েছেন ডিআইজি পদে। গত ১৫ মে রবিবার সকালে পেড়ারাপুর ফাঁড়ির ব্যারাক থেকে উদ্ধার হয় বিশ্বপ্রিয় কুন্ডু নামে এক পুলিশ কনস্টেবলের গলায় দড়ি দেওয়া ঝুলন্ত দেহ। আদতে তাঁর বাড়ি হাওড়ার আন্দুলে। দু’বছর ধরে কাজের সূত্রে তিনি ব্যারাকে থাকতেন। পুলিশের অনুমান, মানসিক অবসাদের জেরেই আত্মহত্যা।
অর্নববাবু জানান, ঘটনাটি তাঁকে বেশ নাড়া দেয়। অনেক সময় দেখা যায় পুলিশ কর্মীরা অবসাদে ভোগেন। তাদের কী কারণে অবসাদ তা কাউকেই বলেন না। কোনও অঘটন ঘটলে তখন জানা যায়। পুলিশের কাজের মধ্যে থাকে অনেক রকম মানসিক চাপ। তার থেকে দেখা দেয় মানসিক অবসাদ। সেই অবসাদ যাতে কোনও পুলিশ কর্মীর মৃত্যু কারণ হয়ে না দাঁড়ায় তার জন্য এর ঠিক পরে ৩১ মে চালু হয় চন্দননগর পুলিশদের মানসিক স্বাস্থ্য শিবির। যার নাম দেওয়া হয় ‘লেটস্ ওপেন আপ’। এর অর্থ খোলাখুলি কথা বলা। চুঁচুড়া থানায় পুলিশ কর্মীদের নিয়ে এর সেশন হয়। অর্ণববাবু বলেন, লেটস ওপেন আপের মাধ্যমে পুলিশ কর্মীরা অফিসারদের তাদের সমস্যার কথা বলতে পারবে কোনও সংকোচ না করেই।
মানসিক চিকিৎসায় পূর্ব ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান এসএসকেএম হাসপাতালের ইন্সটিট্যুট অফ সাইকিঅ্যাট্রি’-র অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ডাঃ সুজিত সরখেল বলেন, “উন্নত দেশগুলোর তুলনায় এমনিতেই ভারতবাসীর মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে চেতনা কম। সেনা থেকে পুলিশ— নানা ধরণের রক্ষীর সবাইকে সারভাইভ্যাল স্ট্রাটেজি হিসাবে একটা রেজিমেন্টেড পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। যেটা সিভিলিয়ানদের ঘরানা থেকে একদম আলাদা। ওপরওয়ালার নির্দেশ, প্রয়োজনে ছুটি না পাওয়া, পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া— এরকম অনেক পরিস্থিতি বাধ্য হয়ে তাঁদের মেনে নিতে হয়। যার প্রভাব পড়ে মানসিক স্বাস্থ্যে। বিষয়টা সকলের জানা। কিন্তু এ ব্যাপারে যতটা যা যা করা প্রয়োজন, নানা কারণে করা হয়ে ওঠেনি। এর ফলশ্রুতি এখানে-ওখানে নানাভাবে দেখা যাচ্ছে।“
পুলিশ কমিশনার অর্ণব ঘোষ বলেন, শারীরিকভাবে অসুস্থ হলে যেমন কাজে সমস্যা হয় পুলিশ কর্মীদের তেমনই মানিসক স্বাস্থ্য ঠিক রাখাও জরুরি। প্রয়োজন হলে পুলিশের কাউন্সিলরের সাহায্য নিতে পারবেন পুলিশ কর্মীরা। কোনো পুলিশ কর্মী যদি নিজে তার সমস্যার কথা বলতে দ্বিধা করেন, তাহলে তার ব্যারাকের সহকর্মীদের থেকে জানা যেতে পারে। কোনও পুলিশ কর্মী কোনও অবসাদগ্রস্ত হচ্ছেন কিনা থানার আইসিদের তা দেখা উচিত। পুলিশের চাকরিতে অনেক রকম চাপ থাকে। ২৪ ঘন্টা ডিউটি করতে হয়। দিনের পর দিন বাড়ি ছেড়ে পরিবার ছেড়ে থাকতে হয়। এ ছাড়া অন্য অনেক কারনে অবসাদ হতে পারে।
বন্দুকধারী রক্ষীদের বিভিন্ন কারণে আগের চেয়েও বেশি চাপের মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে। এই মন্তব্য ‘অখিল ভারতীয় পূর্ব সৈনিক সেবা পরিষদ’-এর প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক অসীম দে-র। এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, “আমি সাড়ে ২৪ বছর সেনাবাহিনীতে কাজ করেছি। এর মধ্যে ৯ বছর ছিলাম জম্মু ও কাশ্মীর সীমান্তে। বাড়ি থেকে থেকে এত দূরে থাকলে সংসারের নানা বিষয় মানসিকভাবে অনেককে খুব চাপের মধ্যে ফেলে দেয়। এখন মোবাইল ফোনের জন্য মন খারাপ করা খবরও আগের চেয়ে বেশি আসে। মানসিক স্থৈর্যটা একটা বড় জিনিস। কিন্তু সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণপর্বটা মারাত্মক কঠিন। জওয়ানদের কাছে এর একটা বিশেষ উপযোগিতা আছে। কিন্তু আজকাল পুলিশে এই প্রশিক্ষণের ওপর কতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়, তা নিয়ে যথেষ্ঠ সংশয় রয়েছে।“
সমাধানের পথ তাহলে কী? ডাঃ সুজিত সরখেল বলেন, “দেখুন, বেসিক কালচারের বদল করা খুব কঠিন। প্রায় সব বাহিনীতেই প্রয়োজনের তুলনায় কম রক্ষী দিয়ে চালাতে হচ্ছে। এই সীমাবদ্ধতা এবং রেজিমেন্টাল পদ্ধতি মেনেই সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। আগের তুলনায় আমরা চিকিৎসা ও প্রশিক্ষণ শিবিরের সংখ্যা বাড়িয়েছি। কিছুদিন আগে সীমা সুরক্ষা বলের (এসএসবি) জওয়ানদের শিবির করলাম। আগামী মাসে ওদের মেডিক্যাল অফিসারদের প্রশিক্ষণ দেব। বিএসএফ এবং সিআইএসএফ-এর জন্যও পর্যায়ক্রমে কিছু সচেতনতা শিবির হবে। কলকাতা এবং রাজ্য পুলিশকেও এ ব্যাপারে আবেদন করা হয়েছে। এ ধরণের ক্রমান্বয় কার্যক্রমে সার্বিকভাবে রক্ষীদের মানসিক সুস্থতার পথ খোঁজা সম্ভব।“