দুরন্ত বার্তা ডিজিটাল ডেস্কঃ আকাশে বাতাসে শরতের আগমনীবার্তা। আর মাত্র কয়েকটি দিনের অপেক্ষা, তারপরই শুরু হবে শারদীয়া দুর্গোৎসব। যেমন শরতের প্রকৃতি জানান দিচ্ছেন মা আসছেন, ঠিক তেমনই কোন্নগরের গোস্বামী বাড়িতে চলছে শেষ মুহূর্তের পুজো প্রস্তুতি। সেখানে বাড়ির মেয়ে উমা ফিরছেন। তবে সেখানে উমা শুধু সঙ্গে করে তার ছেলেমেয়েদেরই নিয়ে আসছেন এমনটা নয়, সঙ্গে করে নিয়ে আসছেন তাঁর পতি ভোলা মহেশ্বরকেও। গোস্বামী বাড়িতে বাড়ির ভিতরেই চলে প্রতিমা তৈরির কাজ।
রথের দিন কাঠামো পুজো ও উল্টোরথের মধ্যে সম্পন্ন হয় খড় বাঁধা। তারপর জন্মাষ্টমীর দিন বসিয়ে দেওয়া হয় প্রতিমার মুখমণ্ডল, তারপর চলে মাটির কাজ। মৃন্ময়ী মাতৃ প্রতিমা নির্মাণ করেন সুদেব গোস্বামীর পুত্র অরিজিৎ গোস্বামী। তিনিই একাধারে প্রতিমা নির্মাণ এবং পুজো করে থাকেন।
হুগলীর কোন্নগরের সুদেব গোস্বামীর বাড়িতে ১৬ বছর ধরে চলে আসছে হরগৌরি পুজো। এই পুজো দেখতে হলে আপনাকে আসতে হবে কোন্নগর স্টেশন, তারপর সেখান থেকে রেড সান (Red Sun) ক্লাবের কাছে এসেই দেখতে পাবেন এই বাড়ির পুজো।
নানান রকমের বৈশিষ্ট্য ও অনন্যতার মেলবন্ধনে চলে আসা এই পুজোর একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, এই পুজো কিন্তু সাধারণ দুর্গা পুজোর মত পাঁচ দিনের পুজো নয়। প্রতিপদে চক্ষুদান ও কল্পারম্ভের মধ্য দিয়ে সূচনা এবং দশমীতে এই পুজোর সমাপ্তি ঘটে। অর্থাৎ গোটা দশ দিন ধরে বাড়ির সদশ্য ও প্রতিবেশিরা মেতে থাকেন এই পুজোয়। শাক্ত এবং বৈষ্ণব, এই দুই মতের সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে এই পুজোর রীতি। এখানে সপ্তমী, অষ্টমী এবং নবমী, এই তিনদিনই বলি দেওয়া হয়।
এই পুজোর অন্যতম এক রীতি হল, সপ্তমীর দিন নব পত্রিকা যখন স্নানে যান, তারপর সেখান থেকে তিনি ফিরে এসে বাড়ির দালানে পুনর্বার স্নান করেন। তারপর সেখান থেকে তাঁকে বরণ করে প্রতিমার পাশে স্থাপনের জন্য যখন নিয়ে যাওয়া হয়, তখন একটি হোম হয়। এই হোমের বিশেষত্ব হল, এটিতে কোনো মন্ত্রের ব্যাবহার হয় না। এবং শুধুমাত্র খইয়ের দ্বারা এই হোম সম্পন্ন হয়। শুধুমাত্র খইয়ের দ্বারা সম্পন্ন হওয়া এই হোম 'লাজ হোম' নামে সুপরিচিত।
গোস্বামী বাড়ির এই পুজোতে সব থেকে বেশি যা প্রাধান্য পায়, তা হল সময়। সমস্ত দিন ব্রহ্ম মুহূর্ত থেকে পূর্বাহ্ণের মধ্যেই পুজো সম্পন্ন হয়। পুজো শুরুর আগে এই বাড়ির গৃহ দেবতা যারা রয়েছেন, অর্থাৎ দামোদরজী ও দেবী লক্ষ্মীর অর্চনা করার চল পরিলক্ষিত। এই বাড়ির পুজোর ভোগের বিশেষত্বও কিন্তু অন্যান্য জায়গার থেকে অনেকটাই ভিন্ন। এই পুজোর সূচনালগ্নে ঠিক যে পরিমাণ ভোগ রান্না করা হত, ঠিক সেই পরিমাণ ভোগ এই বাড়িতে আজও হয়ে আসছে। ভোগের মধ্যে রয়েছে খিচুড়ি, ভাজা ও পায়েস। পূর্বাহ্ণের আগেই এই ভোগ দেবীকে উৎসর্গ করা হয়। আবার সন্ধ্যারতির সময়ও এখানে দেবীকে ভোগ প্রদান করা হয়। সেই ভোগে দেওয়া হয় মাখন, মিছরি ও দুধ। আবার রাতের বেলা হয় নৈশ ভোগারতি, তখন ভোগে দেওয়া হয় নানা রকমের পদ। এই পদের মধ্যে রয়েছে লুচি, সুজি, বিভিন্ন রকমের ভাজা, দই, ক্ষীর, নাড়ু, গজা ও লাড্ডু। ভোগের ক্ষেত্রে কিন্তু কোনরকমের তেলের ব্যাবহার করা হয় না। পুরো ভোগই রান্না করা হয় সম্পূর্ণ ঘিয়ের মাধ্যমে। আবার এই বাড়িতে ছানা দিয়ে তৈরি কোনো মিষ্টি পুজোতে দেওয়া হয় না। ক্ষীর জাতীয় মিষ্টান্নই ভোগে দেবীকে অর্পণ করা হয়। তারপর অষ্টমীর দিনও একই রকম ভাবে পুজো চলে। সেদিন বলি প্রদানের পর সম্পন্ন হয় কুমারী পুজো।
অষ্টমীর দিন সন্ধি পুজোর ক্ষেত্রেও এই বাড়ির পুজোতে লেগে রয়েছে অনন্যতার পরত। সন্ধিপুজোর সময় দেওয়া হয় কুড়ি কেজি চালের নৈবেদ্য এবং গোটা ফল। অর্থাৎ সন্ধিপুজোয় সমস্ত ভোগই কাঁচা অবস্থায় দেওয়া হয়। সন্ধি পুজোয় কোনো রকম পদ্মের ব্যাবহার এই বাড়িতে দেখা যায় না।
নবমীর দিন ঠিক একই ভাবে সম্পন্ন হয় পুজো। এদিন রাতে নৈশ ভোগারতির পর একটি অনন্য প্রথা আজও এই বাড়িতে প্রচলিত। পরের দিনই কৈলাসে ফিরে যাবেন ঘরের মেয়ে ও জামাই। তাই তাঁদের যাওয়ার খরচও দিতে হবে তাঁদের। এবং পান সুপারি দিয়ে পরের বছরের জন্য নেমন্তন্নও করা হয় হরগৌরিকে। জামাইয়ের হাতে অর্থাৎ বিগ্রহের শিবের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় যাত্রা খরচ বাবদ ১৬ আনা।
এই বাড়িতে দশমীর দিন ভোগে দেওয়া হয় পান্তা ভাত, কচু শাক, টক, বড়ি ভাজা এবং দই। দশমী পুজোর পর অপরাজিতা পুজো সম্পন্ন হলে বরণের পর গৌরির কাপড়ের আঁচলে একটি পুটুলিতে বেঁধে দেওয়া হয় এক মুঠো চাল, এক টাকার কয়েন ও পান সুপারি। এই রীতি অনেকটাই বাঙালি মেয়ের কনে বিদায়ের সাথে সম্পর্কিত। বলা হয় বাপের বাড়ি থেকে কৈলাসে ফিরে সেদিন খাবার খেতে পারেন না গৌরি, তিনি তখন ওই চালই রান্না করে খান। এবং বাড়ির মেয়ে গৌরিকে শুভ জিনিস দেখিয়ে বাড়ি থেকে নিরঞ্জনের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। কনকাঞ্জলি দেওয়ার পর আর বিলম্ব হয় না প্রতিমা নিরঞ্জনে।