দুরন্তবার্তা ডিজিটাল ডেস্ক: সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়েই আমাদের দিন শুরু হয় মোবাইল হাতে। অটো হোক বা বাস, ট্রেন হোক বা মেট্রো—যাত্রাপথে চোখ থাকে ফোনের স্ক্রিনে। ইনস্টাগ্রাম রিল কিংবা ফেসবুক পোস্ট স্ক্রোল করতে করতেই কেটে যায় অনেকটা সময়। কোনও রিল পছন্দ হলেই সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়ে দিই প্রিয় বন্ধুর হোয়াটসঅ্যাপে। রান্নার রেসিপি হোক বা ঘর সাজানোর আইডিয়া—এইসব সমাজমাধ্যম থেকেই অনেকেই পান অনুপ্রেরণা।
কিন্তু সম্প্রতি আরও একটি নতুন ট্রেন্ড নজর কাড়ছে—‘টু মিল আ ডে’ বা ‘টুম্যাড’ ডায়েট। বলা হচ্ছে, দিনে মাত্র দু’বার খেলে দ্রুত কমবে ওজন। এই ধারায় পা রেখেছেন বলিউড-টলিউডের একাধিক তারকাও।
এক সময় পুষ্টিবিদেরা জোর দিতেন দিনে বার বার, পরিমিত খাবারের উপর। বলা হত, ছোট ছোট মিল খেলে শরীর সঠিক পুষ্টি পায় এবং বিপাক ক্রিয়া সক্রিয় থাকে। কিন্তু বর্তমান হুজুগে সেই নিয়ম বদলে গিয়েছে। এখন অনেকেই সহজে রোগা হওয়ার আশায় শর্টকাট খুঁজছেন।
তবে প্রশ্ন হল—এই শর্টকাট পথ কতটা নিরাপদ? শুধুই রিল দেখে, কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ছাড়াই ডায়েট পদ্ধতি পাল্টে ফেলা কি সঠিক সিদ্ধান্ত হতে পারে?
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সবার শরীর একরকম নয়। কারও ক্ষেত্রে দিনে দু’বার খাওয়া উপকারী হলেও, অন্যের জন্য তা হতে পারে বিপজ্জনক। তাই কোনও নতুন ডায়েট শুরু করার আগে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
‘টু মিল আ ডে’ ডায়েট আসলে কী?
এই ডায়েটে দিনে মাত্র দু’বার খাওয়া যায়, আর বাকি সময়টা উপোস করেই কাটাতে হয়। এই ডায়েটের সঙ্গে ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং-এর খানিকটা মিল আছে। এ ক্ষেত্রেও সারা দিনে অনেকখানি সময় উপোস করেই থাকতে হয়। এখন এই হুজুগে গা ভাসাচ্ছেন অনেকেই। বন্ধুর পরামর্শে কিংবা সমাজমাধ্যমে রিল ঘেঁটে ‘টু মিল আ ডে’ ডায়েট করার প্রবণতা ইদানীং বেড়েছে। নানা ব্যস্ততার মাঝে প্রতি দিন যাঁরা শরীরচর্চা করার সময় পান না, তাঁদের কাছে এই প্রকার ডায়েট একেবারে হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো। রোগা হওয়ার লক্ষ্যপূরণে এই অভ্যাস কারও কাজে লাগছে। কারও আবার হিতে বিপরীত হচ্ছে।
বেসরকারি স্কুলের শিক্ষিকা তনিমা পাল। বয়স ৩৫। বছরখানেক আগেও যেই তনিমার ওজন ছিল প্রায় ৭০ কেজি, এখন তাঁকে দেখে চেনার উপায় নেই। ওজন ঝরিয়ে এখন তন্বী হয়ে উঠেছে সে। ওজন এখন তাঁর ৬৫ কেজি। কী ভাবে ঝরালেন ওজন? প্রশ্নের জবাবে তনিমা বলেন, ‘‘সংসার আর অফিস সামলে আর শরীরচর্চা করার সময় হয় না। খাওয়াদাওয়া নিয়ন্ত্রণ করেই আমি ভাল ফল পেয়েছি। সারা দিনে আমি মাত্র দু’ বার খাই।’’ ইনস্টাগ্রামের রিল দেখে দিনে মাত্র দু’বার করে খাওয়া শুরু করেছিলেন তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী, ২৭ বছর বয়সি অরিন্দম ঘোষ। তিন দিনের মাথায় অফিসেই মাথা ঘুরে পড়ে যান তিনি। অরিন্দম বলেন, ‘‘অফিসে সারা ক্ষণ ডেস্কে বসে বসে ওজনটা বেশ বেড়ে গিয়েছে। চটজলদি ভুঁড়ি কমাতে রিল দেখে আমিও দিনে দু’বার খেতে শুরু করি। তবে দু’দিন করেই বুঝেছি এই ‘টু মিল আ ডে’ ডায়েট আমার জন্য নয়।’’
‘টু মিল আ ডে’ ডায়েট করার সময় শরীরে যেন প্রয়োজনীয় ক্যালোরির ঘাটতি না হয় সে দিকে নজর রাখা ভীষণ জরুরি, এমনই মত পুষ্টিবিদ শম্পা চক্রবর্তীর। তিনি বলেন, ‘‘যদি কারও শরীরে দিনে ১২০০ ক্যালোরির প্রয়োজন হয় তা হলে দিনের দু’বারের খাবারের প্রতি বারে যেন শরীরে ৬০০ ক্যালোরি পৌঁছোয় তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি মিলে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, গুড ফ্যাট, খনিজ আর ভিটামিনের ভারসাম্য ঠিক রাখতে হবে। এই ডায়েট করলে কার্বোহাইড্রেট কমিয়ে প্রোটিনের পরিমাণ বাড়ানো জরুরি। এই ডায়েট করলেও মাঝেমাঝে কিন্তু ফল, ফলের রস, চা, নানা প্রকার বীজ, বাদাম খাওয়া যেতে পারে। আর দিনে বেশি করে জল খাওয়াও ভীষণ জরুরি। দিনের খাবারে কী কী থাকলে শরীরে পুষ্টির অভাব হবে না, তা একমাত্র পুষ্টিবিদই বলতে পারবেন। তাই কোনও রিল দেখে এমন ডায়েট শুরু করবেন না। পুষ্টিবিদের সঙ্গে পরামর্শ করেই এই প্রকার কোনও ডায়েট শুরু করা উচিত। এই প্রকার ডায়েটে ধরুন সকালে আপানি ৮ টা কিংবা ৯ টা নাগাত প্রাতরাশ করলেন, সে ক্ষেত্রে চেষ্টা করবেন, রাত ৮-৯টার মধ্যে রাতের খাবার খেয়ে নিতে। শরীরে কোনও রকম ক্রনিক অসুখ থাকলে এই ডায়েটের দিকে না ঝোঁকাই ভাল। শিশুদের কিংবা বৃদ্ধদের এই ডায়েট করার পরামর্শ কখনওই দেব না। যাঁদের ওজন বেশি তাদের জন্য এই ডায়েট কাজে আসে। এই ডায়েটে শরীরের বিপাক ভাল থাকে। শরীরে ইনসুলিন রেজ়িস্ট্যান্ট বাড়ে, স্মৃতিশক্তি ভাল রাখতেও সাহায্য করে।’’
নায়িকা ক্যাটরিনা কইফও একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন তিনিও দিনে দু’বার মাত্র খাবার খান, আর তাতেই নাকি ফিট থাকেন তিনি। তবে ডায়েটে তিনি বাড়িতে বানানো খাবারের উপরেই ভরসা রাখেন আর তাঁর প্রতিটি মিলে যেন ক্যালোরির ঘাটতি না হয় আর পুষ্টিগুণের অভাব না হয়, সে দিকে তাঁর সব সময় নজর থাকে। সম্প্রতি ৫৫ কেজি ওজন ঝরিয়েছেন, বলিউড অভিনেতা রাম কপূর। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘‘২০ বছর ধরে আমার ১৪০ কেজি ওজন ছিল। আমার শরীরে পৃথিবীর যাবতীয় রোগ বাসা বেঁধেছিল। আমি বার বার ওজন কমিয়েছি, কিন্তু কয়েক দিনেই আবার আগের ওজনে ফিরে যেতাম। এ বারে কিন্তু আমি ৫৫ কেজি ওজন কমিয়ে ফেলেছি আর এখন আমার শরীরে কোনও রোগ নেই। আমি জীবনধারায় বদল এনেছি, আর তাতেই ফল পেয়েছি। দিনে এখন আমি মাত্র দু’বার খাই। মাঝেমাঝে চা,কফি খেতে থাকি। তবে শুধু ডায়েট করেই যে ওজন কমেছে সে কথা বলব না। ডায়েটের পাশাপাশি শরীরচর্চার জন্যও কঠোর পরিশ্রম করেছি সঙ্গে কিছু অভ্যাসেও বদল এনেছি।’’
পুষ্টিবিদ অর্পিতা রায়ের কাছে যাঁরা ওজন ঝরানোর জন্য পরামর্শ চাইতে আসেন, তাঁদেরকে কখনও ‘টু মিল আ ডে’ ডায়েট করার পরামর্শ দেন না তিনি। অর্পিতা বলেন, ‘‘ওজন কমানোর জন্যও ডায়েটে ভারসাম্য রাখা জরুরি। দিনে কম বার খেয়ে ওজন কমানোর পক্ষপাতী আমি নই। সারা দিনে অন্তত তিন বার, অর্থাৎ প্রাতরাশ, দুপুরের খাবার আর রাতের খাবার খেতেই হবে। আর বিকেলের দিকে স্বাস্থ্যকর নাস্তাও রাখতে হবে রোজের ডায়েটে। বেশি ক্ষণ উপোস করে থাকলে গ্যাস্ট্রিক আলসার, বদহজমের মতো সমস্যা বেড়ে যাবে। এ ছাড়াও নানা রকম সমস্যা দেখা দিতে পারে শরীরে। ডায়াবিটিস থাকলে এই প্রকার ডায়েট একেবারেই করা চলবে না।’’
মডেলিং জগতে তো বটেই, ছোট পর্দার বেশ পরিচিত মুখ শন বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিনয় ছাড়াও তাঁর টান টান মেদহীন ছিপছিপে চেহারা নিয়ে সকলেরই কৌতূহল রয়েছে। শন বলেন, ‘‘আমি নানা ধরনের ডায়েট কিংবা শরীরচর্চা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই থাকি। একটা সময়ও আমিও ‘টু মিল আ ডে’ ডায়েট করে দেখেছি, তবে খুব বেশি দিন করে উঠতে পারিনি। আমি এখন দিন ৪ থেকে ৫ বার খাবার খাই। আমার মনে হয় কত বার খাচ্ছেন তার থেকেও কতটা খাচ্ছেন সে দিকে নজর রাখা বেশি জরুরি। দিনে চার থেকে পাঁচ বার খেলেও খুবই অল্প খাই। আমার শরীরের জন্য এই নিয়মে খাওয়াদাওয়াটাই বেশি কাজ দিয়েছে।’’
টলিউড অভিনেত্রী ঐন্দ্রিলা সেন। চরিত্রের প্রয়োজনে তাঁকেও একাধিক বার কড়া ডায়েটে থাকতে হয়েছে। ঐন্দ্রিলা বলেন, ‘‘এখন অনেকেই দেখি, নানা ধরনের ডায়েট করেন। অনেকে দিনে এক বার মাত্র খাবার খান! কিন্তু সত্যি বলতে, আমি কখনও ‘টু মিল আ ডে’— এই ধরনের ডায়েট করিনি। কারণ কঠিন ডায়েট করলে আমার মাথা যন্ত্রণা শুরু হয়। তাই বেশি দিন করতে পারি না। আমি হয়তো ডায়েট করার সময় তিন থেকে চারটে মিল খেয়েছি। সেখানে মাংস থেকে পেঁপে সেদ্ধও ছিল। আমার ব্যক্তিগত পুষ্টিবিদ সেই ভাবে খাবারের তালিকা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তিন-চার বার খাবার খেলেও ক্যালোরি যেন বেশি না হয়, সে দিকটা অবশ্যই খেয়াল রাখি।’’
আদৌ কি এই ডায়েট করে ওজন ঝরানো স্বাস্থ্যসম্মত? পুষ্টিবিদ পম্পিতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘আমি কখনওই কোনও রকম ক্র্যাশ ডায়েট করার পক্ষপাতী নই। এই প্রকার ডায়েট মোটেই শরীরের পক্ষে ভাল নয়। এতে অজান্তেই শরীরের বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। ডায়েট এমন হওয়া জরুরি, যাতে শরীরে ক্যালোরির চাহিদা পূরণ হয় আর শরীর সব রকম পুষ্টি পায়। তবে নেটমাধ্যম দেখে কোনও পুষ্টিবিদের পরামর্শ ছাড়াই এই রকম ক্র্যাশ ডায়েট শুরু করা মোটেও স্বাস্থ্যকর নয়। এই ডায়েট করার চেয়ে না করাই ভাল।’’
যে কোনও প্রকার ক্র্যাশ ডায়েটের ফলে শরীরে জলের ঘাটতি হতে পারে। এই সময়ে প্রয়োজনের তুলনায় কম ফ্যাট খাওয়া হয়, তখন দেহকোষ পর্যাপ্ত পরিমাণে ফ্যাট পায় না। সেই শূন্যস্থান পূরণ করতেই কোষ শরীরের অতিরিক্ত জল শুষে নেয়। যার ফলে গ্লাইকোজ়েন ভেঙে যায়। আর গ্লাইকোজ়েন ভাঙলেই জলশূন্যতা তৈরি হয়। ডিহাইড্রেশন হলে সঙ্গে সঙ্গে তার প্রভাব পড়ে ত্বক ও শরীরের উপর। শরীরে শক্তি আসে ক্যালোরি থেকে। হঠাৎ করে কম ক্যালোরির খাবার খেলে শরীরের পেশির উপর প্রভাব পড়ে। পেশির শক্তি কমে আসে। ক্লান্তি আসে। সারা ক্ষণ ঝিমুনি ভাব এবং কাজকর্মে অনীহা দেখা দেয়। ক্র্যাশ ডায়েটের ফলে শরীরে স্ট্রেস হরমোনের ক্ষরণ অনেকখানি বেড়ে যায়। ফলে বিষণ্ণতা, ঘন ঘন মেজাজ পরিবর্তন ইত্যাদি হতেই পারে। তা ছাড়া ক্র্যাশ ডায়েটের ফলে দেহে সঠিক মাত্রায় ভিটামিন আর মিনারেলের ঘাটতি হয়। ফলে ত্বকের ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে যায়। চুল পড়ে যাওয়া বা অনিয়মিত ঋতুচক্রের সমস্যাও দেখা দেয়।
অভিনেতা বিক্রম চট্টোপাধ্যায়কে ‘টু মিল আ ডে’ ডায়েট নিয়ে প্রশ্ন করা হলে, তিনি বলেন, ‘‘আমি নিজে এ ধরনের কোনও ডায়েট করিনি। দিনে দু’বার খেয়ে আমি থাকতে পারব না। সারা দিনে আমি সাধারণত তিন বার খাবার খাই। কখনও কখনও কোনও বিশেষ চরিত্রের জন্য পেশিবহুল চেহারা তৈরি করতে হলে দিনে চার-পাঁচ বারও খেতে হয়। আমি কখনও কোনও রকম ক্রাশ ডায়েট করিনি। আমার মনে হয় না ওই প্রকার ডায়েট খুব একটা স্বাস্থ্যকর।’’
কিন্তু পুষ্টিবিদের পরামর্শ ছাড়া, শরীরের ভালমন্দ চিন্তা না করে শুধুমাত্র হুজুগে গা ভাসিয়ে এই ধরনের ডায়েট করা কি ঠিক? পুষ্টিবিদ এবং যাপন সহায়ক অনন্যা ভৌমিক বলেন, “ডায়েট বা ডাক্তারি কোনওটিই ইন্টারনেট ঘেঁটে শেখা যায় না। প্রতিটি মানুষের শরীর আলাদা। ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং করে বন্ধু রোগা হয়েছেন বলে আমারও সেই পদ্ধতি কাজে লাগবে, এমনটা কিন্তু নয়। আমি বলছি না সমাজমাধ্যমে এই ধরনের ডায়েট নিয়ে যা যা বলা হচ্ছে, তার সবটা ভুল। তবে কার ক্ষেত্রে কোনটা উপযুক্ত, তা একজন চিকিৎসকের পক্ষেই বোঝা সম্ভব।”
ডায়েট বিষয়টি পুরোটাই ব্যক্তিনির্ভর। আপনার শরীরের কী কী সমস্যা রয়েছে, আপনার ওজন কত, আপনার জীবনধারা কেমন, উচ্চতা কত— সবটা দেখে তবেই একজন পুষ্টিবিদ আপনার শরীরেরে পক্ষে উপযুক্ত হবেন এমন ডায়েট করার পরামর্শ দেন। তাই শরীর নিয়ে এই ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করার পরামর্শ দিচ্ছেন সকলেই। সমাজমাধ্যমে ডায়েট, শরীরচর্চা নিয়ে কে কী বলছেন বা আমাদের চারপাশে কী ঘটছে, সে সব দেখে-জেনে রাখা অবশ্যই ভাল। কিন্তু নিজের উপর তা প্রয়োগ করার আগে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।