কলকাতা, ১৩ এপ্রিল: “আমাদের সময় এই দিনটি ছিল অন্যরকম আনন্দের দিন। তখন গরম থাকলেও এত ভয় ছিল না। এখন তো শুধুই হিট স্ট্রোকের ভয়। আমরা মাথায় রুমাল জড়িয়ে কলেজ স্ট্রিটে যেতাম। কেউ ছাতা ব্যবহার করত না। সেই যাওয়ার মধ্যেই ছিল প্রবল আনন্দ।”
বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনের স্মৃতি এভাবেই রোমন্থন করেছেন প্রবীন সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, “পয়লা বৈশাখ এখন শুধুই স্মৃতি। কারণ কলেজ স্ট্রিটে আগের মতো পয়লা বৈশাখ পালন হয় না। এখন বিভিন্ন জায়গায় বইমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।”
শনিবার রাত পোহালেই ১ বৈশাখ। বইপাড়ার ব্যবসায়ী-প্রকাশকরা এই মুহূর্তে দারুণ ব্যস্ত বাংলা নববর্ষকে স্বাগত জানাতে। অনেকে ই-আমন্ত্রণপত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন শুভানুধ্যায়ীদের কাছে। পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ডের সভাপতি তথা ‘পত্রভারতী’-র কর্ণধার ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায় জানান, ‘পত্রভারতী’র শুরু ১৯৮৩ সালে। গত ২০ বছর ধরে আমরা নববর্ষের আড্ডার আয়োজন করছি। আমাদে গোষ্ঠীর মোট প্রকাশনা (টাইটেল) ১১০০-র বেশি।”
লেখিকা-প্রকাশক রূপা মজুমদারের মতে, “বর্ষবরণের এই দিন উদযাপন বাঙালির কাছে তাৎপর্যমণ্ডিত বিশেষত দুটি কারণে। এক, এটি সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ একটি উৎসব; দুই, এই দিনটিতে জড়িয়ে আছে বাঙালির ব্যবসা। ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এই বিশেষ দিনটি থেকেই গণেশ পুজো করে কালী-মায়ের থানে হিসেবের খাতা স্পর্শ করিয়ে বছরের ব্যবসার শুভারম্ভ করে। ব্যবসার মধ্যে বাঙালির কাছে এককালে বই ব্যবসা বিশেষ স্থান অধিকার করে থাকত। তাই পয়লা বৈশাখের দিনে বইকে কেন্দ্র করে বইপাড়ায় প্রকাশকের ঘর লেখক-পাঠকের সমাগমে এবং আড্ডায় থাকত মুখর হয়ে। এখনও থাকে।”
বিভিন্ন বছর পত্রভারতীর নববর্ষের আড্ডায় এসেছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। এ-ছাড়াও আসেন এই সময়ের বিশিষ্ট লেখকরা। মিষ্টিমুখের ব্যবস্থা করা হয়। ত্রিদিববাবুর কথায়, “সবাই মিলে খুব আনন্দ করি। এবারেও আমন্ত্রিতের সংখ্যা প্রায় এক হাজার।“ কিন্তু পাঠাভ্যাস কমে যাওয়ায় কি চিন্তা হচ্ছে? পরিবর্ত কোনও ভাবনা? ত্রিদিববাবুর জবাব, “আমরা মনে করি না, বই পড়া কমে যাচ্ছে, অন্তত আমাদের প্রকাশনায় তার কোনও প্রভাব পড়েনি।”
দে’জ পাবলিশিং হাউসে সাতের দশকের মাঝামাঝি শুরু হয় নববর্ষের আড্ডা। এবারও আয়োজিত হবে। সংস্থার পুরোধা তথা গিল্ডের কর্তা সুধাংশুশেখর দে জানিয়েছেন, “একটা সময় আমাদের নববর্ষের আড্ডায় বসত চাঁদের হাট। সবাই খুব মজা করতেন। আসতেন সমরেশ বসু, সন্তোষকুমার ঘোষ, সুবোধ ঘোষ, গৌরকিশোর ঘোষ, রমাপদ চৌধুরি, বিমল কর, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শঙ্করীপ্রসাদ বসু, শংকর, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, নারায়ণ সান্যাল, নিমাই ভট্টাচার্য, প্রফুল্ল রায়, বরুণ সেনগুপ্ত, সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ, পূর্ণেন্দু পত্রী, শঙ্খ ঘোষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, অমিতাভ দাশগুপ্ত, তারাপদ রায়, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, নবনীতা দেবসেন, বাণী বসু, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।” সমাবেশকে সফল করতে কোমড় বেঁধে লেগেছে দে’জ-এর হবু মালিক শুভঙ্কর (অপু)।
রূপা মজুমদারও নববর্ষে অনেককে আমন্ত্রণ জানান ঝামাপুকুরে দেব সাহিত্য কুটিরে তাঁর অফিসঘরে। লেখক-সমাবেশে বসেন। তিনি জানিয়েছেন, “সত্যি বলতে কি, পুজো পার্বণ ব্যতীত বাংলার সন তারিখ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আর কোনো প্রভাব ফেলে না। ব্যতিক্রম শুধু বর্ষবরণের দিনটি। বঙ্গাব্দের এই প্রথম দিনটি আমরা যথাসাধ্য বাঙালিয়ানা দিয়েই পালন করি।”