Editorial

1 hour ago

অনুপ্রবেশ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী,প্রমাণহীন অভিযোগ কি রাজনৈতিক বক্তব্যকে গুরুত্বহীন করে তুলছে?

Prime Minister Narendra Modi
Prime Minister Narendra Modi

 

ভারতের রাজনীতিতে অনুপ্রবেশের প্রশ্ন দীর্ঘদিন ধরেই একটি স্পর্শকাতর ইস্যু। সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলিতে এই প্রসঙ্গ নতুন নয়, বরং গত কয়েক দশক ধরে এটি নানা রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রে থেকেছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন একটি সভায় দাঁড়িয়ে আবারও অনুপ্রবেশের প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি নতুন করে আলোচনার জন্ম দিল। তবে এখানে যে প্রশ্নটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় তা হলো—কোনও স্পষ্ট তথ্য বা প্রমাণ ছাড়া শুধুমাত্র রাজনৈতিক ভাষণে এই ধরনের অভিযোগ করলে সেটির ওজন কতটা থাকে, কিংবা জনমানসে এর প্রভাব কতটা পড়ে। বিশেষত, যখন দেশের শাসক দলের সর্বোচ্চ নেতা নিজেই বিষয়টি উত্থাপন করেন, তখন সেটি নিছক নির্বাচনী প্রচারের অংশ বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় কি না, সেই নিয়ে মতভেদ দেখা দিয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের মূল তাৎপর্য ছিল যে দেশের নিরাপত্তা ও সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট করার জন্য বহিরাগত অনুপ্রবেশকারীরা ক্রমশ ভারতে প্রবেশ করছে। কিন্তু এখানে একটি গুরুতর প্রশ্ন থেকেই যায়—এই অভিযোগের পক্ষে প্রমাণ কোথায়? সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনী থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক পর্যন্ত কারও তরফ থেকে সাম্প্রতিক সময়ে এমন কোনও সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রকাশ্যে আসেনি যা প্রমাণ করে যে ব্যাপক হারে অনুপ্রবেশ ঘটছে। পরিসংখ্যান ছাড়া, তথ্য ছাড়া, প্রমাণ ছাড়া একটি রাজনৈতিক ভাষণ হয়তো সাময়িক আবেগ তৈরি করতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে সেটি গুরুত্ব হারায়। কারণ জনগণ এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি সচেতন, তথ্যপ্রযুক্তির বিস্তারের ফলে মানুষ খুব দ্রুত বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য যাচাই করতে সক্ষম হচ্ছে। তাই শুধু আবেগের ওপর নির্ভর করে কোনও দাবি টিকিয়ে রাখা আগের মতো সহজ নয়।

এই প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী মোদীর বক্তব্যের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। একজন দেশের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ নিছক রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা হতে পারে না, তার মধ্যে একটা গুরুতর দায়বদ্ধতা থাকে। কারণ প্রধানমন্ত্রী কেবল একটি দলের প্রতিনিধি নন, তিনি গোটা দেশের মুখ। তাই তাঁর মুখ থেকে বের হওয়া প্রতিটি শব্দের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। যদি প্রমাণ ছাড়া তিনি অনুপ্রবেশের মতো সংবেদনশীল ইস্যু উত্থাপন করেন, তাহলে এর ফলে দেশের ভেতরে অযথা বিভাজন বাড়তে পারে, এবং রাজনৈতিক লাভের উদ্দেশ্যে সমাজে অবিশ্বাসের বীজ বপন হতে পারে।

এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—অনুপ্রবেশ ইস্যুটি প্রায়শই ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিভাজনের সঙ্গে যুক্ত করে দেখা হয়। রাজনৈতিক দলগুলি এই প্রসঙ্গকে ব্যবহার করে নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ভয় বা সন্দেহ তৈরি করতে চায়। অথচ বাস্তব পরিস্থিতি অনেক জটিল। সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলিতে স্থানীয় মানুষের যাতায়াত, পেশা, আত্মীয়তার সম্পর্কের কারণে এপার ওপারের সংযোগ অস্বাভাবিক নয়। তাছাড়া আইনসঙ্গত অভিবাসন ও অবৈধ অনুপ্রবেশের পার্থক্য সবসময় স্পষ্ট নয়। যদি যথাযথ তথ্য উপস্থাপন না করা হয়, তাহলে পুরো বিষয়টি একধরনের রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবেই রয়ে যায়, যা সমাজকে আরও বিভক্ত করে।


প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে আরও একটি সমস্যা চোখে পড়ে—এই ধরনের প্রমাণহীন অভিযোগ আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সম্পর্ককেও জটিল করে তুলতে পারে। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক গত কয়েক বছরে নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গেছে। সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব যেমন গুরুতর, তেমনই কূটনৈতিক ভারসাম্যও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী যদি তথ্য ছাড়া বারবার অনুপ্রবেশের অভিযোগ করেন, তাহলে প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এর ফলে আঞ্চলিক সহযোগিতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের ভাবমূর্তিও প্রশ্নের মুখে পড়বে।

অন্যদিকে, দেশের সাধারণ মানুষও এখন রাজনৈতিক ভাষণের মূল্যায়ন ভিন্নভাবে করছেন। কেবল আবেগতাড়িত করে ভোট পাওয়ার দিন ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে। বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, শিক্ষার মান, স্বাস্থ্য পরিকাঠামো—এই সবই এখন ভোটারদের কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ। তাই অনুপ্রবেশের মতো একটি গুরুতর প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী যদি যথেষ্ট তথ্য না দেন, তবে তা মানুষের কাছে গুরুত্বহীন হয়ে যেতে পারে। বরং জনগণ মনে করতে পারে, এই ধরনের বক্তব্য কেবলমাত্র প্রকৃত সমস্যাগুলি থেকে নজর ঘোরানোর জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে।

গণতন্ত্রে বিরোধী দলগুলির কাজ হলো শাসক দলের বক্তব্যকে যাচাই করা এবং প্রয়োজন হলে তার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলা। তাই বিরোধী দলগুলির তরফ থেকে ইতিমধ্যেই বলা হচ্ছে যে, প্রধানমন্ত্রী যদি অনুপ্রবেশের অভিযোগ করেন তবে তার পক্ষে তথ্যপ্রমাণ সংসদে বা জনগণের সামনে আনতে হবে। শুধু রাজনৈতিক সভায় আবেগ জাগিয়ে তোলা যথেষ্ট নয়। এই দাবি অযৌক্তিক নয়, কারণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনজবাবদিহি থাকা অত্যাবশ্যক। একজন সাধারণ নাগরিক যেমন প্রমাণ ছাড়া অভিযোগ করলে আদালতে তা টিকে না, তেমনই একজন প্রধানমন্ত্রীও প্রমাণ ছাড়া অভিযোগ করলে তার বিশ্বাসযোগ্যতা কমে যায়।


এখানে প্রশ্ন ওঠে, তবে কি অনুপ্রবেশ সমস্যা নেই? একেবারেই নেই, তা বলা যাবে না। সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলিতে অতীতে অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটেছে, আজও হয়তো কিছু পরিমাণে হচ্ছে। কিন্তু সমস্যার প্রকৃত রূপ বোঝার জন্য দরকার নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান, বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং প্রশাসনিক তথ্য। সরকার যদি সত্যিই মনে করে যে ব্যাপক হারে অনুপ্রবেশ ঘটছে, তবে তা প্রমাণ করার জন্য তাদের হাতে তথ্য থাকা উচিত। সেই তথ্য সংসদে পেশ করা উচিত, এবং প্রয়োজনে সাদা কাগজ প্রকাশ করে জনগণকে জানানো উচিত। তাহলে শুধু রাজনৈতিক বক্তব্য নয়, একটি প্রশাসনিক অবস্থানও স্পষ্ট হবে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে এই স্পষ্টতা অনুপস্থিত। বরং এটি আরও একটি নির্বাচনী ভাষণের মতো শোনায়, যা সমাজে বিভাজনের রাজনীতিকে উসকে দিতে পারে। গণতন্ত্রে রাজনীতির জায়গা থাকলেও, দায়িত্বশীল নেতৃত্বের কাছে জনগণ আশা করে তথ্যভিত্তিক বক্তব্য এবং সমস্যার সমাধানমূলক উদ্যোগ। প্রমাণ ছাড়া কেবল আতঙ্ক ছড়ালে তা নেতৃত্বের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে। তবে এর মধ্যেই একটি ইতিবাচক দিকও রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী যখন অনুপ্রবেশের প্রসঙ্গ তোলেন, তখন অন্তত বিষয়টি নিয়ে জনচর্চা শুরু হয়। মিডিয়া থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত এ নিয়ে আলোচনায় অংশ নেয়। সেই আলোচনার ফলে অনেক সময় সমস্যার প্রকৃত রূপ সামনে আসে। কিন্তু দায়িত্বশীল নেতৃত্বের আসল কাজ হলো, আলোচনার সূত্রপাত করা নয়, বরং আলোচনাকে বাস্তব তথ্য দিয়ে সমৃদ্ধ করা। সেই জায়গায় এখনও ঘাটতি রয়ে গেছে।

সবশেষে বলা যায়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মতো একজন নেতার কাছ থেকে মানুষ আরও বেশি দায়িত্বশীল ও তথ্যসমৃদ্ধ বক্তব্য প্রত্যাশা করে। অনুপ্রবেশের মতো স্পর্শকাতর ইস্যু নিয়ে কথা বলার সময় প্রমাণের অভাব বক্তব্যকে কেবল দুর্বলই করে না, বরং সেটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে হয়। এর ফলে আসল সমস্যা আড়ালে থেকে যায়, এবং জনমানসে শাসক দলের ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখে পড়ে। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে আবেগ জরুরি, কিন্তু প্রমাণ তার চেয়েও জরুরি। প্রমাণ ছাড়া আবেগ দীর্ঘস্থায়ী হয় না, আর প্রমাণ ছাড়া অভিযোগ জনগণের আস্থা হারায়। প্রধানমন্ত্রী যদি সত্যিই এই সমস্যা নিয়ে উদ্বিগ্ন হন, তবে তাঁর উচিত হবে তথ্য প্রকাশ করা, বাস্তবতার নিরিখে পদক্ষেপ নেওয়া এবং জনতাকে সঠিক চিত্রটি দেখানো। নচেৎ, তাঁর বক্তব্য হয়তো নির্বাচনী মঞ্চে হাততালি পাবে, কিন্তু ইতিহাসে তার কোনও স্থায়ী গুরুত্ব থাকবে না।


You might also like!