দেশের অর্থনৈতিক বিকাশে নারীশক্তির ভূমিকা আজ আর বিতর্কের বিষয় নয়। কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ যত বাড়ে, ততই দেশের উৎপাদনশীলতা ও আয় বৃদ্ধি পায়। কিন্তু বাস্তব চিত্র এখনও আশাব্যঞ্জক নয়। পরিসংখ্যান বলছে, ভারতের মোট শ্রমশক্তির প্রায় অর্ধেক নারী, অথচ তাদের কর্মসংস্থান হার পুরুষদের তুলনায় অনেক কম। এর পিছনে বহু সামাজিক ও অবকাঠামোগত কারণ রয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো পরিস্কার, নিরাপদ ও ব্যবহারযোগ্য পাবলিক টয়লেটের অভাব।
বিশেষ করে শহর ও গ্রামীণ এলাকায় নারী কর্মীদের জন্য উপযুক্ত স্যানিটেশন সুবিধা এখনও বড় চ্যালেঞ্জ। অনেক নারী আজও অফিস, বাজার, কারখানা বা মাঠে কাজের জায়গায় গিয়ে শৌচাগার ব্যবহারের সুযোগ পান না। দিনের পর দিন তারা পানীয় জল কম খান, যাতে টয়লেটে যেতে না হয়। এতে তাদের শারীরিক সমস্যার ঝুঁকি বাড়ে—মূত্রনালির সংক্রমণ, কিডনির সমস্যা, এমনকি গাইনোকলজিক্যাল অসুস্থতা পর্যন্ত। এভাবে একদিকে যেমন তাদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়, অন্যদিকে কাজের প্রতি মনোযোগ ও উৎপাদনশীলতাও কমে যায়।
একটি দেশ তখনই প্রকৃত অর্থে এগিয়ে যায়, যখন তার নারীরা নিরাপদ ও সম্মানজনক পরিবেশে কাজ করতে পারেন। কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য শিক্ষা, নিরাপত্তা, সমান বেতন—এসবের পাশাপাশি পরিষ্কার ও নিরাপদ পাবলিক টয়লেট একটি মৌলিক প্রয়োজন। অথচ আজও বহু সরকারি অফিস, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এমনকি জনবহুল বাজারে মহিলাদের জন্য আলাদা টয়লেট নেই। যেগুলো আছে, সেগুলোর অধিকাংশই নোংরা, জলবিহীন এবং অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় পড়ে থাকে।
পরিষ্কার ও স্বাস্থ্যকর পাবলিক টয়লেট নির্মাণ কেবলমাত্র নারীর আরাম বা সৌজন্যের প্রশ্ন নয়, এটি দেশের অর্থনীতির সঙ্গেও গভীরভাবে যুক্ত। যদি মহিলারা অফিসে বা বাইরে নির্ভয়ে কাজ করতে পারেন, তবে তাদের কর্মসংস্থান বাড়বে। এক্ষেত্রে উদাহরণ টানা যেতে পারে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের মতো দেশগুলোর, যেখানে নারী শ্রমশক্তি বৃদ্ধির ফলে দেশগুলোর জিডিপি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ভারতের মতো বৃহৎ অর্থনীতির দেশে যদি নারীরা সমান হারে কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হতে পারেন, তাহলে দেশের জিডিপি কয়েক লক্ষ কোটি টাকা বাড়তে পারে।
শহরাঞ্চলে মেট্রো, বাজার, রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড—সব জায়গাতেই পাবলিক টয়লেটের চাহিদা বিপুল। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, বেশিরভাগ জায়গায় পুরুষদের জন্য শৌচাগার থাকলেও, নারীদের জন্য টয়লেট হয় অপর্যাপ্ত, নয়তো নিরাপত্তাহীন। অনেক সময় এগুলির দরজা বন্ধ থাকে, আলো থাকে না, পরিচ্ছন্নতার ব্যবস্থা থাকে না। এর ফলে অনেক নারী বাইরে দীর্ঘ সময় কাজ করা বা বেরোনো এড়িয়ে চলেন। গ্রামের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও কঠিন। অনেক জায়গায় এখনও খোলা জায়গায় মলত্যাগের প্রথা চলে আসছে, যা নারীদের জন্য শুধু অসুবিধাজনকই নয়, বরং গভীর নিরাপত্তা ঝুঁকিও তৈরি করে।
সরকার গত কয়েক বছরে ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’-এর মাধ্যমে স্যানিটেশন উন্নয়নে বড় পদক্ষেপ নিয়েছে। বহু টয়লেট নির্মাণ হয়েছে শহর ও গ্রামে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—এই টয়লেটগুলো কতটা ব্যবহারযোগ্য, পরিষ্কার এবং রক্ষণাবেক্ষণযোগ্য অবস্থায় রাখা হচ্ছে? নির্মাণই যদি চূড়ান্ত লক্ষ্য হয়, তাহলে বাস্তব উন্নয়ন কখনও সম্ভব নয়। প্রয়োজন নিয়মিত পরিস্কার, পর্যাপ্ত জল, নিরাপত্তা রক্ষী, সিসিটিভি নজরদারি এবং নারীদের জন্য আলাদা সুবিধা।
পাবলিক টয়লেট ব্যবস্থায় প্রযুক্তির ব্যবহারও এক নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। যেমন ‘স্মার্ট টয়লেট’ প্রকল্পের মাধ্যমে সেন্সর-নিয়ন্ত্রিত ফ্লাশ, স্বয়ংক্রিয় পরিস্কার ব্যবস্থা, ডিজিটাল পেমেন্টের সুবিধা ইত্যাদি যুক্ত করা যেতে পারে। এতে টয়লেট ব্যবহারের মান বাড়বে, পাশাপাশি রক্ষণাবেক্ষণও সহজ হবে। অনেক দেশে স্থানীয় মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে টয়লেটের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়, যার ফলে একদিকে স্যানিটেশন ব্যবস্থা উন্নত হয়, অন্যদিকে তাদের আয়ও বাড়ে।
এখন সময় এসেছে সরকার, পৌরসভা, বেসরকারি সংস্থা এবং নাগরিক সমাজ—সবাই মিলে এই সমস্যাকে জাতীয় অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখার। কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হলে তাদের মৌলিক চাহিদাগুলি নিশ্চিত করতেই হবে। শৌচাগার একটি মৌলিক মানবাধিকার। এটিকে “নারীর প্রয়োজন” হিসেবে নয়, বরং “নাগরিকের অধিকার” হিসেবে দেখা দরকার।
অর্থনীতির দিক থেকেও বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, যে সংস্থাগুলি নারী-বান্ধব পরিকাঠামোতে বিনিয়োগ করে, তাদের উৎপাদনশীলতা গড়ে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ে। কারণ, কর্মীরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করলে কাজের মান স্বয়ংক্রিয়ভাবে উন্নত হয়। একইসঙ্গে এটি নারীর আত্মবিশ্বাস ও মর্যাদা বাড়ায়, যা দীর্ঘমেয়াদে কর্মস্থলের সংস্কৃতি ও সমাজের মানসিকতায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
পরিষ্কার, নিরাপদ ও সহজলভ্য পাবলিক টয়লেট কেবল স্যানিটেশনের প্রশ্ন নয়—এটি নারীর স্বাধীনতার প্রশ্ন, তার কাজের সুযোগের প্রশ্ন, তার সম্মানের প্রশ্ন। আজও বহু প্রতিভাবান মেয়ে বা মহিলা চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন শুধু এই কারণে যে, অফিস বা যাত্রাপথে শৌচাগারের ব্যবস্থা নেই। এই অবস্থা পরিবর্তন করা গেলে দেশের কর্মশক্তির অর্ধেক অংশ নতুন করে কর্মক্ষেত্রে ফিরতে পারে।
একটি দেশের প্রকৃত অগ্রগতি তখনই হয়, যখন তার অর্ধেক জনগোষ্ঠী—অর্থাৎ নারীরা—অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সমানভাবে অংশ নিতে পারেন। কিন্তু তার আগে তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণের দায় নিতে হবে সমাজ ও রাষ্ট্রকে। তাই আজ প্রয়োজন এক সর্বভারতীয় স্যানিটেশন বিপ্লব, যেখানে প্রতিটি রাস্তার মোড়ে, অফিস এলাকায়, বিদ্যালয়ে, বাজারে থাকবে পরিচ্ছন্ন ও নিরাপদ পাবলিক টয়লেট। শুধু নির্মাণ নয়, তার নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণও হবে বাধ্যতামূলক। নারীর সম্মান রক্ষার সঙ্গে সঙ্গে এটি হবে দেশের অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধির এক দৃঢ় পদক্ষেপ। কারণ, যখন নারী নির্ভয়ে কাজ করবে, দেশ তখন দ্বিগুণ গতিতে এগিয়ে যাবে।
পরিষ্কার ও স্বাস্থ্যকর পাবলিক টয়লেট কেবল দেয়াল ও ছাদের একটি কাঠামো নয়—এটি এক সভ্য সমাজের প্রতীক, যেখানে নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্যই সমান সুযোগ নিশ্চিত করা হয়। তাই আজই সময় এসেছে এই মৌলিক অবকাঠামোগত প্রয়োজনকে জাতীয় উন্নয়নের অঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার। সবার জন্য শৌচাগার গড়া মানে সবার জন্য অগ্রগতি গড়া—এই সহজ সত্যটি যেন আমরা ভুলে না যাই।