দুরন্ত বার্তা ডিজিটাল ডেস্কঃ যেমন উষ্ণ সূর্য আকাশকে সোনার রঙে রাঙিয়ে দেয় এবং বাতাস আনন্দের সুবাস বহন করে, ওনামের দীপ্তিময় উৎসব কেরলের মানুষের হৃদয় এবং ও সামাজিক ব্যবস্থাপনাকে এক অন্য মার্গে নিয়ে যায়। দশ দিনব্যাপী এই বাৎসরিক উৎসব কেবলই একটি উৎসব নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক সিম্ফনি যা ঐতিহ্য, আচার-অনুষ্ঠান এবং ঐক্যের এক অনবদ্য সংমিশ্রন , যা প্রতিফলিত করে ভারতের ঐতিহ্য ও সৌভাতৃত্বকে।
ভারতের দক্ষিনী রাজ্যের এই ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান ঘিরে এক লৌকিক পুরাকথা বহুল রুপে প্রচলিত রয়েছে। শোনা যায় ওনাম পরোপকারী রাজা মহাবলীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের স্মৃতিচারণ করে,যিনি কেরালাকে সমৃদ্ধি এবং সম্প্রীতির সুবর্ণ যুগে শাসন করেছিলেন। এই দশদিনের উৎসবে আচার-অনুষ্ঠানের একটি চমৎকার ট্যাপেস্ট্রি রয়েছে যা এই অঞ্চলের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরে।
এই উৎসবের সূচনা হয় "পুক্কালাম" দিয়ে। সাধারনত এই অনুষ্ঠানে স্থানীয় পরিবার গুলি সতেজ ও রঙবেরঙের ফুলের দ্বারা সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন ফুলের আলপনায় নিজেরদের গৃহ ও লোকালয়কে সুসজ্জিত করে থাকেন। এই শিল্পের দ্বারা তারা তাদের প্রিয় রাজা মহাবলীর প্রতি ভক্তি ও সন্মানকে প্রতিফলিত করে থাকেন।
পুক্কালামের মতই এই অনুষ্ঠানের আরো একটি উল্লেখযোগ্য ও বিশেষ অনুষ্ঠান হল বল্লমকালী। এটি ওনামের সবচেয়ে আনন্দদায়ক অনুষ্ঠানের অন্যত্তম বলে পরিচিত। রঙিনসাজে সজ্জিত নৌকাগুলি নির্মান করা হয় গৌরবময় অতীতের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করার জন্য। মূলত এই অনুষ্ঠানকে সম্পন্ন করার সময় দলগত কাজ, শক্তি এবং প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবের এক সুন্দর সমাহার চোখে পড়ে যা সত্যিই প্রসংশনীয়।
বল্লমকলীর শেষে অনুষ্টিত হয় "ওনাসাদ্যা"। যা মূলত একটি প্রীতিভোজের অনুষ্ঠান। কলা পাতায় পরিবেশিত সুস্বাদু ও সুন্দর সুগন্ধি খাদ্য সম্ভার যা দৃষ্টি নন্দন হবার পাশাপাশি রসনাকে পরিতৃপ্ত করতেও অনন্য ভূমিকা পালন করে। ওনামের আরো একটি বিশেষ অনুষ্ঠান হল থুম্বি থুল্লাল এবং কাইকোত্তিকালি। এই অনুষ্ঠান ব্যাতিত ওনাম অসম্পূর্ণ। মূলত এটি একটি নৃত্যানুষ্ঠান। এক মনোরম মনোমুগ্ধকর নৃত্যশৈল্য যা নারীদের দ্বারা সম্পাদিত হয়ে থাকে। এই নৃত্যগুলি তাদের আনন্দ এবং ছন্দের দ্বারা সম্পাদিত হয়ে থাকে যা সম্প্রীতি ও সাংস্কৃতিক ঐক্যের প্রতীক।
ওনাম এক আনন্দময় উদযাপন যা সমস্ত সীমানা অতিক্রম করে সমস্ত বয়স, বর্ণ এবং পটভূমির মানুষকে ঐক্য ও ভালবাসার সুতোয় আবদ্ধ করে। সাদা ও সোনালী রঙা পোশাক পরিহিত ট্রাডিশনাল গহনায় সজ্জিত মেয়েরা সঙ্গীত অনুরননের মাধ্যমে অনুষ্ঠানটিকে এক অনন্য পর্যায়ে উন্নিত করে। ওনাম উদযাপনের একটি অন্যত্তম অংশ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যা শৈল্পিক ও সংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরে। এই অনুষ্ঠানের অন্যত্তম রিচুয়াল অথাচাময়ম, এতে সুসজ্জিত হাতির এক বিশাল শোভাযাত্রা দেখতে পাওয়া যায়, যা ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলার এক অনবদ্য নিদর্শন দর্শিত করে থাকে।
ওনামের মাধ্যমে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের চেতনার এক অপূর্ব সঙ্গীতের অনুরনন অনুভূত হয়ে থাকে। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সৌভাতৃত্ব ও ঐক্যের মনোভাবের উজাগরন হয়ে থাকে। এই অনুষ্ঠানের দিন গুলিতে মানুষ সকল ভেদাভেদকে দূরে সরিয়ে রেখে ঐক্যের বাঁধনে নিজেদেরকে আবদ্ধ করে, যা সত্যিই দৃষ্টান্তমূলক। এই উৎসবের মাধ্যমে কেবল মানব সমাজের মধ্যে সম্পর্কে দৃড়তা আসে না। মানুষ সমাজ ও প্রকৃতির মধ্যেও এক গাড় সম্পর্কের সমীকরন তৈরী হয়। একে অপরের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বেঁচে থাকার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা তৈরী করে।
ওনামের মধ্যে নিহিত আছে কয়েটি চিরন্তন বার্তা - একতা, কৃতজ্ঞতা এবং জীবনের প্রাচুর্যের উদযাপনের সারমর্ম। উৎসবের আচার-অনুষ্ঠান এবং উদযাপনগুলি একটি সুন্দর আখ্যান বয়ন করে যা প্রজন্মকে অতিক্রম করে, আমাদের ভবিষ্যতের আলিঙ্গন করার সময় আমাদের অতীতের সাথে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে এক সুন্দর সেতুবন্ধন তৈরী করে। এই উদযাপন আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমাদের সাংস্কৃতিক শিকড় শুধু কল্পকথা নয়, এ এক উত্তরাধিকার যা সময়ের ট্যাপেস্ট্রির মাধ্যমে সকল প্রজন্মের মধ্যে সৌহার্দ্য ও সম্প্রতির মনোভাবের সৃষ্টি করে চলছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।