অথচ এমনটা তো হওয়ার কথা নয়! পুনের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ট্রপিক্যাল মেটিওরোলজি (আইআইটিএম)-র তথ্য অনুযায়ী কলকাতা ও সংলগ্ন অঞ্চল মার্চ-এপ্রিল মিলিয়ে অন্তত ছ’টি এবং মে মাসে আরও ছ’টি — মোট ১২টি কালবৈশাখী পেত। গত বছরও মে-র কলকাতা কালবৈশাখী পেয়েছে পাঁচটি। তা হলে মার্চ-এপ্রিলের উপর এমন বিরক্ত কেন প্রকৃতি? বদলাচ্ছে নাকি জলবায়ুর প্যাটার্ন?
দেশে বর্ষাকালের সময়সীমায় যে কিছুটা বদল হয়েছে, আবহবিদদের বড় অংশই সে ব্যাপারে নিশ্চিত। তার পর এ বার কি কালবৈশাখীর পালা? না, এত তাড়াতাড়ি ওঁরা এ নিয়ে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছননি। অন্তত ৩০-৩৫ বছরের ডেটা না মিলিয়ে ‘ট্রেন্ড বদল’ শব্দটা ব্যবহার করতে চান না আবহবিদরা। কিন্তু ২০২২-এর মার্চ-এপ্রিলে একটিও কালবৈশাখী না হওয়া, ২০২৩-এর মার্চ ও এপ্রিল মিলিয়ে ছয়ের বদলে মাত্র দুটো কালবৈশাখী এবং ২০২৪-এ ফের কালবৈশাখীহীন মার্চ ও এপ্রিল যে ইঙ্গিত দিচ্ছে, সেটা খুব ভালো চোখে দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা।
কাকে বলে কালবৈশাখী? বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের যে কোনও ঝড়বৃষ্টির সঙ্গে এর ফারাক কোথায়?
আবহবিদরা বলছেন, ‘কালবৈশাখী মানেই ঝড়বৃষ্টি, তবে সব ঝড়বৃষ্টি কালবৈশাখী নয়। ঝড়বৃষ্টির সময়ে কোনও জায়গায় টানা এক মিনিট বা ৬০ সেকেন্ড ধরে যদি ঘণ্টায় অন্তত ৪৫ কিলোমিটার বেগে হাওয়া দেয়, একমাত্র তাকেই কালবৈশাখী বলা হয়।’ আলিপুর আবহাওয়া অফিসের আবহবিদরা জানাচ্ছেন, ২০২৩-এর ২৭ এপ্রিল কলকাতায় ঘণ্টায় ৭৯ কিলোমিটার বেগে হাওয়া দিয়েছিল। ‘কালবৈশাখী’ তকমা পেতে গেলে হাওয়ার যা গতি হতে হয়, সে দিন তার চেয়ে অনেক বেশিই ছিল। কিন্তু স্থায়িত্ব ৬০ সেকেন্ডের পরিবর্তে ৫৭ সেকেন্ড হওয়ায় তাকে কালবৈশাখী বলা যায়নি।
কেন হয় কালবৈশাখী? আবহবিদরা জানাচ্ছেন, গরম পড়তেই ছোটনাগপুর মালভূমি উত্তপ্ত হতে শুরু করে। সেখানকার গরম হাওয়া হালকা হয়ে উপরের দিকে উঠে যায়। ওই ফাঁকা জায়গা পূরণ করতে বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয় বাষ্পপূর্ণ ভিজে বাতাস দক্ষিণ-পূর্ব দিকে থেকে ধেয়ে যায়। মালভূমির শুকনো ও গরম বাতাস সমুদ্রের ভিজে ও ঠান্ডা বাতাসের সঙ্গে মিশে মেঘ তৈরি করে। গোটা শীতকাল ধরে শুকিয়ে যাওয়া বায়ুমণ্ডলের ভাসমান কণা চার্জড অবস্থাতেই থাকে। ওই বাতাসের সঙ্গে মেঘ মিশে বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টি নামায়।
মৌসম ভবনের পূর্বাঞ্চলীয় শাখার উপ-মহাধ্যক্ষ সোমনাথ দত্ত বলেন, ‘উত্তর গোলার্ধে সমুদ্র থেকে বাতাস যখন কোনও দেশের মূল ভূখণ্ডে ঢোকে, তখন অ্যান্টি-ক্লকওয়াইজ়, অর্থাৎ ঘড়ির কাঁটার উল্টো ভাবে ঘুরতে শুরু করে। বঙ্গোপসাগরের যে হাওয়া দক্ষিণবঙ্গ দিয়ে ঢোকে, সেটা বাঁ দিকে বেঁকে ওডিশার দিকে চলে যায়। তাই বাংলার পাশাপাশি ওডিশাও কালবৈশাখীর দিকে তাকিয়ে থাকে। ঝড় শুরু হলে, হাওয়া পাশাপাশি পাক খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গে মাটির এক কিলোমিটার উপর থেকে কনকনে ঠান্ডা হাওয়াও গুঁতো খেয়ে অতি দ্রুত নীচে নামতে থাকে। এর ফলে অনেকটা জায়গার তাপমাত্রা কয়েক মিনিটের মধ্যে ১২-১৫ ডিগ্রি পর্যন্ত কমে যায়। অনেক সময়ে শিলাবৃষ্টিও হয়।’
এটাই যদি প্রাকৃতিক নিয়ম হয়, তা হলে গত ক’বছর এমন হচ্ছে না কেন? সম্ভাব্য কারণ হিসেবে আবহবিদরা মনে করছেন, ছোটনাগপুর মালভূমির শূন্যস্থান পূরণ করতে দেশের পশ্চিম দিক থেকে প্রবল গরম হাওয়া — যাকে চলতি কথায় ‘লু’ বলা হয়, তীব্র গতিতে ঢুকছে। ওই হাওয়ার জোর আপাতত এত বেশি যে তার ধাক্কায় বঙ্গোপসাগরের ভিজে বাতাস দেশের মূল ভূখণ্ডে ঢুকতে পারছে না। আইআইটিএম জানাচ্ছে, কালবৈশাখীর মেঘ তৈরি হয় মাটি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার উপরেই।
কিন্তু গত ক’বছরে লু-এর প্রভাবে ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় এক কিলোমিটার উপর পর্যন্ত বাতাসের স্তর এতটাই গরম হয়ে উঠছে যে সেই উচ্চতায় মেঘ তৈরি হতে পারছে না বলেই বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ। সমুদ্রের বাতাসের জোর করে ঢোকার মতো শক্তি অর্জন করতে অতিরিক্ত প্রায় দু’মাস সময় লেগে যাচ্ছে। তাই মার্চ-এপ্রিলে ঝড়বৃষ্টির পরিমাণ অত্যন্ত কমে সবটাই মে-নির্ভর হয়ে পড়েছে।
এ বছরও সমুদ্রের বাতাসকে দু’মাস ধরে কার্যত গায়ের জোরে ঠেকিয়ে রেখেছে শক্তিশালী ‘লু’। তবে, কিছুটা সক্রিয় হয়েছে হিমালয়। উত্তর দিক থেকে ঠান্ডা বাতাস নীচে নামছে। আবহবিদদের একাংশের আশা, হিমালয়ের ওই ঠান্ডা বাতাসের প্রভাবে পশ্চিমা বায়ুর মুখ দ্রুত ঘুরবে ও জোর কমবে। ফলে সমুদ্রের হাওয়ার পথ সহজ হবে। একই সঙ্গে বাতাসের স্তরের তাপমাত্রাও কিছুটা নেমে যাবে। সব মিলিয়ে গরম ও বাষ্পপূর্ণ বাতাসের মিলন হয়ে মেঘ জমার পথ সুগম হবে। এ সবের প্রভাবেই মে মাসের ৫-৬ তারিখ নাগাদ দক্ষিণবঙ্গের আবহাওয়ায় পরিবর্তনের আশা খুব বেশি। কপাল সত্যিই ভালো হলে দেখা মিলতে পারে মরশুমের প্রথম কালবৈশাখীরও।