Editorial

1 year ago

National Science Day : জাতীয় বিজ্ঞান দিবস

Editorial
Editorial

 

আধুনিক বিজ্ঞান চর্চার প্রাণ কেন্দ্র জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ি 

রবীন্দ্রকুমার শীল

( ২৮ শে ফেব্রুয়ারি জাতীয় বিজ্ঞান দিবস। এই দিনে প্রখ্যাত ভারতীয় পদার্থ বিজ্ঞানী চদ্রশেখর ভেঙ্কট রামন তাঁর রামন-এফেক্ট’ আবিস্কারের সম্মান পালন করা হয়। ১৯২৮ সালে ২৮ ফেব্রুয়ারি রামন এফেক্ট আবিস্কার করেছিলেন। এই আবিস্কারের জন্য ১৯৩০ সালে রামন, পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তারপর থকেই এই দিনটি ভারতে জাতীয়  বিজ্ঞান দিবস হিসাবে পালিত হচ্ছে। ১৯৮৬ সালে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা যোগাযোগ আয়োগ ভারত সরকারের কাছে জতীয় বিজ্ঞান দিবস হিসাবে পালন করার জন্য আবেদন করলে সরকার তা পালন করতে অনুমতি দিয়েছিল।

 ভারতের আধুনিক বিজ্ঞান চর্চার প্রধান কেন্দ্র হিসাবে কলকাতার নাম সবার আগে করতে হয়। সেই সময়ে মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চা করার ব্যাপারে জোড়াসাঁকোর ভূমিকার কথা অবশ্যই উল্লেখ করতে হয়। রাজা রামমোহন রায়, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং অক্ষয় কুমার দত্ত, বিদ্যাসাগর মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, জগদীশচন্দ্র বোস,প্রফুল্লচন্দ্র রায় তৎকালীন সময়ের বিশেষ বিশেষ বিজ্ঞান সাধকগনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন। 

বিশ্বকবি ‘বিশ্ব পরিচয়’ নামে একটি বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের বই রচনা করেছিলেন তা আজও বহু বিজ্ঞানীদের কাছে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে।তাঁরই বিজ্ঞান চর্চা নিয়ে আজকের প্রবন্ধ।বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু মাত্র সাহিত্য চর্চা করেছেন তা নয়, তিনি বিজ্ঞান এবং চিকিৎসা চর্চায় মগ্ন থেকেছেন। রাজা রামমোহন রায়ও বিজ্ঞান চর্চা করেছেন। বিজ্ঞান চর্চা বাংলায় বৃদ্ধি লাভ না করতে পারলে সমাজ সংস্কার করা একেবারে অসম্ভব সেটা অনুভব করতে পেরেছিলেন রাজা রামমোহন রায়। তারপরেই যার কথা আসে তিনি বিদ্যাসাগর মহাশয়। তিনিও বিজ্ঞান চর্চার পাশাপাশি চিকিৎসা চর্চা করেছেন। তাঁর ‘জীবন চরিত’ গ্রন্থে ইউরোপের বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের জীবনী নিয়ে আলোচনা করেছেন। 

রাজা রামমোহন রায় অনুভব করতে পেরেছিলেন যে ইংরেজরা শক্তি অর্জন করতে পেরেছে তার মূল কারণ হচ্ছে বিলাতে শিল্প বিপ্লব। বিজ্ঞানে উন্নতি না করতে পারলে ইংরেজদের পক্ষে সারা বিশ্ব জয় করা একেবারে অসম্ভব ছিল। বিজ্ঞানে অভূতপূর্ব উন্নতি করার ফলে ইংরেজরা বিশ্বের অন্যতম সেরা জাতি হিসাবে পরিগণিত হতে থাকে। তাদের শিক্ষা প্রাঙ্গনে বিজ্ঞান চর্চা প্রাধান্য লাভ করতে থাকে। পদার্থ বিজ্ঞান থেকে শুরু করে বিজ্ঞানে বিভিন্ন বিভাগের চর্চার পাশাপাশি চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে চর্চা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তারই প্রভাব বাংলায় এসেও পড়িছল। 

রাজা রামমোহন রায় সমাজ সংস্কারের কাজে নিয়োজিৎ হয়ে উপলব্ধি করেন  বিজ্ঞান চর্চার শ্রীবৃদ্ধি করতে হবে। রামমোহন রায়ের পথ ধরে জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির সদস্যরা বিজ্ঞান চর্চার ব্রতী হন। উলেক্ষ্য ইতিমধ্যে ঠাকুর বাড়িতে শুরু হয়ে গিয়েছিল বিজ্ঞান চর্চা। 

প্রসঙ্গত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থের বহু জায়গায় তিনি যে এক সময়ে বিজ্ঞান চর্চার দিকে মনোনিবেশ করতে শুরু করেছিলেন তার বর্ননা আমরা পেয়ে থাকি। 

ভারতের বিজ্ঞান সাধক আচার্য্য জগদীশচন্দ্র বোসের সঙ্গে তাঁর পদার্থ  বিজ্ঞান নিয়ে বহু কথা হয়েছিল তার উল্লেখ ও পাই। তিনি পদার্থ বিজ্ঞান চর্চা থেকে শুরু করে রসায়ন বিজ্ঞান চর্চার শ্রীবৃদ্ধি যাতে হয় তার দিকে লক্ষ্য রেখে পদক্ষেপ গ্রহণ করার পক্ষে ছিলেন। ভৌত বিজ্ঞান চর্চা থেকে শুরু করে পরিবেশ বিজ্ঞান এবং জীব বিজ্ঞান নিয়েও কবিগুরু চর্চা করেছেন। 

বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের সঙ্গে ও সেই সময় কথা বলতেন রবীন্দ্রনাথ। চারবার তিনি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ ও করেছিলেন। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার ওপরে তিনি বেশি করে জোর দিয়েছিলেন যাতে সবার কাছে বিজ্ঞানকে সহজে পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে। সেই দিকে লক্ষ্য রেখে তিনি ১৯৩৭ সালে ‘বিশ্ব পরিচয়’ নামে একটি উন্নত মানের বিজ্ঞান বিষয়ক বই রচনা করেছিলেন। ‘বিশ্বপরিচয়’ গ্রন্থে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখছেন,‘ বড়ো অরণ্যে গাছতলায় শুকনো পাতা আপনি খসে পড়ে, তাতেই  মাটিকে করে উর্বরা। বিজ্ঞানচর্চার দেশের জ্ঞানের টুকরো জিনিসগুলি কেবলই ঝরে ঝরে ছড়িয়ে পড়েছে। তাতে চিত্তভূমিতে বৈজ্ঞানিক উর্বরতার জীবধর্ম জেগে উঠতে থাকে।’  

অন্যদিকে,পরমাণু সম্পর্কে লিখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলছেন যে বিশ্বসৃষ্টির আদি আন্তে মধ্যে প্রকাশ্যে আছে বা লুকিয়ে আছে বিভিন্ন অবস্থায় এই তেজের কাঁপন। পাথর লোহাকে বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় তাদের নড়াচড়া নেই। তারা যেন স্থিরত্বের আদর্শ স্থল। কিন্তু প্রমাণ হয়ে গিয়েছে যে তারা ভিতরে ভিতরে কাঁপছে। রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞানী নন। কিন্তু মাত্র তেরো বছর বয়সেই তিনি ছিলেন বিজ্ঞান সাধনার পুজারি। এই সংস্কৃতির হাত ধরেই মাত্র বারো বছর বয়েˆসই লিখে ফেললেন বিজ্ঞান বিষয় এক প্রবন্ধ-‘ গ্রহগণ’ জীবের আবাসভূমি। এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৭৪ সালে অক্ষর কুমার দত্তের ‘তত্ত্ববোধনী’ পত্রিকাতে। 

এখানে মনে রাখা দরকার যে তখন ‘তত্ত্ববোধনী’ পত্রিকা যদিও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অর্থানুকুল্যে প্রকাশিত হচ্ছিল। কিন্তু অক্ষয় কুমার দত্তের মতো বিজ্ঞান সাধক ছিলেন এই পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। যদি সেই সময়ে বিদ্যাসাগরও তাঁর হাত মিলিয়ে সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। সেই পত্রিকায় প্রবন্ধ প্রকাশ করাটা অতি সাধারণ ব্যাপার ছিল না। উপযুক্ত মানের প্রবন্ধ না হলে সেখানে কোনও লেখা প্রকাশ করা একেবারে অসম্ভব ছিল। কিন্তু সম্পাদক অক্ষয় কুমার দত্ত কিশোর রবীন্দ্রনাথের লেখার মধ্যে নতুনত্বের স্বাদ পেয়েছিলেন বলেই তিনি তাঁর সম্পাদিত পত্রিকায় এই প্রবন্ধটি প্রকাশ করেছিলেন। 

উল্লেখ্য,ঠাকুর বাড়ির পাঠ্যতালিকায় পদার্থ বিজ্ঞান, জীব বিজ্ঞান থেকে শুরু করে রসায়নও অন্তর্ভূক্ত ছিল। প্রকৃতি বিজ্ঞান শিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রতি রবিরার ঠাকুর বাড়িতে এসে উপস্থিত হতেন সীতানাথ দত্ত। পিতা দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চায় সুপণ্ডিত। দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ছিলেন প্রাণী বিজ্ঞান চর্চায় পারদর্শী। এদের সহচর্য লাভ করে রবীন্দ্রনাথ  পড়ে ফেললেন হাক্সলির জীবতত্ত্ব ( ম্যানস প্লেস ইন নেচার) এবং স্যার রবার্ট বলের জ্যোতির্বিদ্যা (দ্য স্টোরি অপ দ্য হেভেন)। তারপরে তিনি লিখে ফেললেন  ‘আচার‌্য জগদীশের জয়বার্তা’ এবং ‘জড় কি সজীব’ নামে দুটি অসাধারণ প্রবন্ধ। আচার্য্য জগদীশ চন্দ্র বোস তখন প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন জড় পদার্থের মধ্যে পরিবর্তনের রূপরেখা দেখতে পাওয়া যায়।তারা স্থিরবস্তু বলে গ্রহণ করা হলেও তাদের মধ্যে কম্পন অনুভব করতে পারা যায়। এই কাঁপন থাকার ফলে জড়বস্তু নিজেদের পরিবর্তন করতে সক্ষম। 

রবীন্দ্রনাথের সময়টা ছিল বিজ্ঞানে স্বর্ণযুগ। তিনি ১১ বার ইউরোপ গিয়েছিলেন এবং পাঁচ বার আমেরিকাতে। জাপানে গিয়ে তিনি অনুভব করতে পেরেছিলেন জাপান নিজেদের নতুন করে তৈরি করতে শুরু করে দিয়েছেন বিজ্ঞানের ওপরে নির্ভর করে। আগামি দিনে জাপান বিজ্ঞানে বহুদূর পর্যন্ত এগিয়ে যাবে সেটা তিনি অনুভব করতে পেরেছিলেন। আজকে প্রযুক্তির যুগে জাপানের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো বিশ্বে কোনও অদ্বিতীয় শক্তি নেই। তার একটি মাত্র কারণ হচ্ছে সেখানকার প্রতিটি বাসিন্দারা বিজ্ঞান মনস্ক। বাঙালিদের বিজ্ঞান মনস্ক হতে হবে। নাহলে কিন্তু বাংলার উন্নতি একেবারে অসম্ভব। বাংলা চিরকালই অন্ধকারে থেকে যাবে। সেখান থেকে মুক্তি পেতে গেলে অতি অবশ্যই বিজ্ঞান চর্চার প্রয়োজন। নাহলে বাংলাকে বাঁচানো যাবে না। 

আজকে মাদ্রাজ, ওড়িশা, কেরলবাসীরা বিজ্ঞান চর্চাকে প্রাধান্য দিতে শুরু করেছে। তার ফলে তারা উন্নত রাজ্যে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু বাংলায় অতীতে যেভাবে বিজ্ঞান চর্চার ওপরে জোর দেওয়া হয়েছিল আজকে সই স্থান থেকে বাংলার সরে যাওয়ার ফলে বাঙালিরা আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না। সেই কারণে বাংলার প্রতিটি কোনে কোনে বিজ্ঞান চেতনার পাশাপাশি চিকিৎসা চর্চাকেও বৃদ্ধি করার দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। বিজ্ঞানের দিকে অগ্রসর হলে সাহিত্য থেকে শুরু করে আর্থিক দিক সবদিক থেকে বাংলা প্রকৃত শক্তিশালী রাজ্যে পরিণত হয়ে উঠবে। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বিশ্বপরিচয়’ বইটি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে উৎসর্গ করেছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে উদ্দেশ্য করে  রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘এই বইখানি তোমার নামের সঙ্গে যুক্ত করছি। বলা বাহুল্য এর মধ্যে এমন বিজ্ঞানসম্পদ নেই যা বিনা সংকোচে তোমার হাতে দেবার যোগ্য। তা ছাড়া, অনধিকার প্রবেশের ভুলে আশঙ্কা করে লজ্জা বোধ করছি, হয়তো তোমার সম্মান রক্ষা করাই হল না। কয়েকটি প্রামান্য গ্রন্থ সামনে রেখে সাধ্যমত নিড়ানি চালিয়েছি। কিছু ওপড়ানো হল। আমার দুঃসাহসের দৃষ্টান্তে যদি কোনো মনীষী, তিনি একাধারে সাহিত্যরসিক ও বিজ্ঞানী, এই অত্যাবশ্যক কর্তব্যকর্মে নামেন, তা হলে আমার এই চেষ্টা চরিতার্থ হবে। ’ কবি কতখানি কুণ্ঠিতবোধ করতে শুরু করেছিলেন তা এই লেখা দেখেই প্রমাণ পাওয়া সম্ভব। পরবর্তীকালে আমরা দেখতে পাই বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ কবি কথাকে মর্যাদা দিয়ে বিশ্ববন্দিত বিজ্ঞানী হতে পেরেছিলেন।  


You might also like!