দুরন্ত বার্তা ডিজিটাল ডেস্কঃ ভরা শ্রাবনেও জলের টান রাজ্যজুড়ে। খারিফ আমন ধান চাষে জলসঙ্কটে জেরবার চাষীরা। শুকিয়ে কাট জমি। কেন্দ্র- রাজ্য জল জোগানের তরজা চরমে উঠেছে। জলসংরক্ষনের ফিরিস্তি শুনে ক্লান্ত রাজ্যবাসী। অন্যদিকে ১০ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের সবুজ সঙ্কেত না পাওয়ায় ঝুলে রয়েছে গুরুত্বপুর্ন জলাধার তৈরীর প্রকল্প। ঝাড়খন্ডের বলপাহাড়ী জলাধার তৈরী প্রকল্প এখনও লাল ফিতের ফাঁসে ফাইলবন্দি।
প্রসঙ্গত, পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খন্ড রাজ্যে বহুমুখী নদী পরিকল্পনায় কেন্দ্রীয় দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন (ডিভিসি) গঠিত হয়। উদ্দ্যেশ্য নদীর ওপর জলাধার নির্মান করে বন্যা নিয়ন্ত্রন, সেচ, জল সংরক্ষন, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ, পরিবেশ সংরক্ষণ, বনসৃজন এবং ডিভিসি প্রকল্পের আওতাধীন অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষদের আর্থ-সামাজিক উন্নতি। ডিভিসি গঠনের পর থেকে মোট ৭ টি জলাধার নির্মানের প্রস্তাব পাশ হয়। যার মধ্যে পাঞ্চেত, মাইথন, কোনার ও তিলাইয়া তৈরী হয়েছে। বর্ষায় অতিরিক্ত জলরাশি পাঞ্চেত ও মাইথন জলাধার থেকে ছাড়তে হয়। ওই বাড়তি জলরাশি সংরক্ষন রাখতে ২০১২ সালে ডিভিসি ঝাড়খন্ডের বলপাহাড়ীতে জলাধার তৈরীর উদ্যোগ নেয়। সেই মত তৈরী হয় ডিপিআর। ডিভিসি সুত্রে জানা গেছে, ঝাড়খন্ডের গিরিডি জেলা বলপাহাড়ীতে প্রায় ৭০০ একর জমির ওপর জলাধারটি তৈরী হবে। যার জলধারন থাকবে সেচের জন্য ৩ লক্ষ ৬০ হাজার একর ফুট, শিল্প ও নগরায়নের জন্য থাকবে ৩ লক্ষ ৩০ হাজার একর ফুট। জলাধারের ওই জলে দুই রাজ্যের ১ লক্ষ ৩৬ হাজার ৭০০ একর জমি চাষে উপকৃত হবে। ২০১২ সালে প্রকল্পের খরচের হিসাব ধরা হয় প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে ওই খরচের পরিমান দাঁড়াবে ৮ হাজার কোটি টাকা। এখনও পর্যন্ত ডিভিসির সর্ব বৃহৎ জলাধার হবে বলপাহাড়ী। যার উদ্দেশ্য, বন্যা নিয়ন্ত্রনের পাশাপাশি সেচের জল সংরক্ষন। অতি বর্ষায় অতিরিক্ত জল যা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়, সেই জল সংরক্ষন রাখা। জলাধারটি তৈরী হলে পশ্চিমবঙ্গ বেশী উপকৃত হবে। তাছাড়াও ৪১৫ মিলিয়ন কিউবিক মিটার শিল্পায়নে ও পানীয় জলের জন্য সুবিধা পাবে। বলপাহাড়ী জলাধার নির্মান হলে মাইথন জলাধারের আয়ু আরও প্রায় ৬০ বছর বাড়বে।
এদিকে জলসঙ্কটে জেরবার রাজ্যবাসী। সম্প্রতি জলসঙ্কট হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে বাংলার কৃষক থেকে সাধারন মানুুষ। গত ২০১৯ ও ২০২০ সালে পর পর দুবার দুর্গাপুর ব্যারেজে লকগেট বিপর্যয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছিল রাজ্যের শিল্পায়নের সঙ্গে কৃষিতে ও মৎস্যজিবীকায়। মুলত জুন মাস থেকে আমন ধানের চাষ শুরু হয়ে যায়। এবং সেপ্টম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত চলে। আলিপুর আবহাওয়া দফতর সুত্রে জানা গেছে, চলতি মরশুমে বাঁকুড়া, পশ্চিম বর্ধমানে এখনও পর্যন্ত ৩৫-৪০ শতাংশ বৃষ্টিপাতের ঘাটতি রয়েছে। তার মধ্যেও বৃষ্টি ও অন্যান্য সেচ ব্যাবস্থার মাধ্যমে অনেক জমি চাষ করেছে চাষীরা। খারিফ চাষে সবথেকে বেশী সঙ্কটে পড়েছে বাঁকুড়া জেলার চাষীরা। পুর্ব বর্ধমান জেলা কৃষি দফতর সুত্রে জানা গেছে, এবছর খারিফ চাষের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৩ লক্ষ ৭৮ হাজার হেক্টর জমি। তার মধ্যে প্রায় ৫৫ হাজার হেক্টর জমি চাষ হয়েছে। চলতি মরশুমে গত ২৭ জুলাই পশ্চিমবঙ্গে চাষের জন্য ৭৫ হাজার একরফুট সেচের জল দেয়। তাতে দুই বর্ধমান, বাঁকুড়া, হাওড়া এবং হুগলী জেলার মোট পাঁচ লক্ষ একর জমি ডিভিসির ছাড়া জলে সেচের জলের সুবিধা পাবে। কিন্তু, ঝাড়খন্ডে অনাবৃষ্টির দরুন জলস্তর নামতে শুরু করে মাইথন জলাধারে। আগামীদিনে পানীয় জল সরবরাহের কথা মাথায় রেখে, সেচের জল জোগান বন্ধ করে দেয় ডিভিসি। আর তাতেই আরও সঙ্কটে পড়ে এরাজ্যের চাষীরা। চলতি সপ্তাহের মধ্যে পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হলে, আমন ধানের চাষ কার্যত লাটে উঠবে। বিকল্প সেচ ব্যাবস্থায় চাষ শুরু করা না হলে, চাল উৎপাদনে আরও সঙ্কট বাড়বে বলে আশঙ্কা। অনাবৃষ্টির দরুন আগামী রবি মরশুমে বরো ধানের চাষে জলের টান পড়বে। চাল উৎপাদনে আরও সঙ্কটের আশঙ্কা করছে চাষীরা। আর ধান চাষ না হলেও, চালের দাম আকশছোঁয়া হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইতিমধ্যে পুর্ব বর্ধমানের গলসীর চাষীরা শ্যালো মাধ্যমে সেচের ব্যাবস্থা রূপায়নের দাবী তুলেছে। ডিভিসির চিপ্ ইঞ্জিনিয়ার (জল বিভাগ) এ.কে. দুবে জানান," জলাধার তৈরীর জন্য ঝাড়খন্ড ও পশ্চিবঙ্গ সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন। পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রজক্টে কিছু সংশোধনের জন্য বলেছিল। সেসব সংশোধন করে পাঠানো হয়েছে। এখনও সেই অনুমোদন দেয়নি।" পাশাপাশি আপত্তি তুলেছে ঝাড়খন্ড সরকারও। তাদের দাবী, জলাধারটি তৈরী হলে বহু গ্রাম উচ্ছেদ হবে। আর তাতে নারাজ ঝাড়খন্ড সরকার।
আর তার জেরে আটকে রয়েছে বলপাহাড়ী জলাধার তৈরীর প্রকল্প। এদিকে জলসঙ্কটে জেরবার রাজ্যবাসী। সম্প্রতি জলসঙ্কট হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে এরাজ্যের কৃষক থেকে সাধারন মানুুষ। তবে ডিভিসি জানিয়েছে, চলতি খারিফ মরশুমে আমন ধান চাষে ৭৫ হাজার একরফুট জল আমন চাষের জন্য দেওয়া হয়েছে। যদিও, খারিফ চাষে জলের প্রয়োজন ২ লক্ষ একরফুট। স্বাভাবিকভাবে যদি বৃষ্টি না হয়, তাহলে ডিভিসির দেওয়া জল পর্যাপ্ত নয়। একইসঙ্গে গত দু বছর ধরে ১০০ দিনের কাজ বন্ধ থাকায় শাখা ক্যানেলগুলি সংস্কার তেমনভাবে হয়নি। অনেকক্ষেত্রে আগাছা, আবর্জনায় মজে গেছে। তাই ওই জল কতটা জমিতে পৌঁছাবে সেটা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
ডিভিসি সূত্রে জানা গেছে, মাইথন জলাধারে জলধারন ক্ষমতা ৪৮৩ ফুট জল রয়েছে। কিন্তু এখন মাইথন জলাধারে জলস্তর রয়েছে ৪৬১.২৯৬ ফুট। একইরকমভাবে পাঞ্চেত পাঞ্চেত জলাধারে ৪২৫ ফুট পর্যন্ত জলধারন ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু, অনাবৃষ্টির দরুন, জলাধারে জলস্তর ৪০০. ৩৩ ফুটে দাঁড়িয়েছে। ঝাড়খন্ডে বৃষ্টি না হওয়ার দরুন ওই দুই জলাধারে জলস্তর ক্রমশ কমছে। অন্যদিকে পলি পড়ে নাবত্যা কমেছে দামোদর নদের ওপর দুর্গাপুর ব্যারেজের। ডিভিসির চিপ্ ইঞ্জিনিয়ার ( জল বিভাগ) এ.কে দুবে জানান," ঝাড়খন্ডে বৃষ্টি না হওয়ার দরুন মাইথন জলাধারে জলস্তর অনেকটাই কমেছে। পানীয় জলের জন্য পর্যাপ্ত জল রেখে সেচের জল দেওয়া হচ্ছে। তার মধ্যে বৃষ্টি হলে সেচের জলের জোগান চাহিদা মত বাড়ানো হবে।"