দুরন্ত বার্তা ডিজিটাল ডেস্কঃ নির্বাচন কমিশনের অবস্থানে অ্যাডভান্টেজ তৃণমূল, অ্যাডভান্টেজ অভিষেক। এই অ্যাডভান্টেজ নিয়েই শুক্রবার জলপাইগুড়িতে প্রচারে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূল এটাকে পুঁজি করে প্রচার করবে, বিজেপি বাংলাবিরোধী। ঘটনাটি কি? উত্তরবঙ্গে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলিকে বাড়ি করে দিতে রাজ্য সরকার টাকা দিতে পারবে না। এ নিয়ে অনুমতি চেয়ে রাজ্য সরকারের আবেদন খারিজ করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
আর সেটাকে একজন দুঁদে রাজনীতিকের মতো খেলিয়ে নিলেন অভিষেক। গত বুধবার রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করে রাজভবন থেকে বেরিয়ে এসে এনিয়ে কমিশনকে তীব্র আক্রমণ করেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এ ব্যাপারে দরকারে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর কাছেও যাবে তৃণমূল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ বলতে বাধ্য হচ্ছেন, বঙ্গ বিজেপির পরামর্শকে মর্যাদা দিতে গিয়ে নির্বাচন কমিশন মাঝে মাঝে এতটাই লুজ ডেলিভারি করছে যে তৃণমূলের 'বাপি বাড়ি যা' ঢঙে ব্যাট চালাতে কোনও অসুবিধাই হচ্ছে না।
গত সপ্তাহে জলপাইগুড়ির ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যের বিষয়টি তার সেরা উদাহরণ। উল্লেখ্য, গত সপ্তাহে উত্তরবঙ্গে জলপাইগুড়ি ও সংলগ্ন এলাকায় আচমকা ঝড়-বৃষ্টিতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। অনেক ঘরবাড়ি ক্ষতি হয়। সেই রাতেই তৃণমূল সুপ্রিমো তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। বিজেপির লবেজান অবস্থা দেখে রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস সেই রাতেই ঘোষণা করলেন, তিনি পরদিন জলপাইগুড়ি যাচ্ছেন।
পরদিন তিনি গেলেন, বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীও গেলেন, কিন্তু ততক্ষণে মমতা দশ গোল দিয়ে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তৃণমূল সুপ্রিমো রীতিমতো ঘাঁটি গেড়ে বসে রইলেন উত্তরবঙ্গে। আলাপচারিতায় মেতে রইলেন চা বাগানের কুলিকামিনদের সঙ্গে, উত্তরবঙ্গের সাধারণ মানুষের সঙ্গে। সেই উত্তরবঙ্গ, যেখানে ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপি আটটির মধ্যে সাতটিই তুলে নিয়ে রাজ্যে ১৮ স্কোর করেছিল।
২০২১ সালের বিধানসভা ভোটেও ৫৪টার মধ্যে ৩০টা আসন গেরুয়া শিবিরের দখলে ছিল। সেখানে প্রথম চিড় ধরায় ধূপগুড়ি। বিজেপি বিধায়কের মৃত্যুতে ওই কেন্দ্রে উপনির্বাচন। ভোট প্রচারে এসে অভিষেকের মাস্টারস্ট্রোক, তৃণমূল প্রার্খী জিতলে ধূপগুড়ি মহকুমা হবে, যা ওই অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি। জিতে গেলেন তৃণমূল প্রার্থী নির্মলচন্দ্র রায়। বিজেপির স্থানীয় ও জেলা নেতৃত্ব স্বীকার করল তৃণমূলের এই মাস্টারস্ট্রোকেই তারা ঘায়েল।
জলপাইগুড়িতে লোকসভার আগে বিধানসভা উপনির্বাচনের হিসাব ধরলে সেটা তৃণমূলের প্রথম গোল। এবার জলপাইগুড়ি লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী সেই নির্মলচন্দ্র রায়। ঘাসফুল শিবিরের কাছে আশীর্বাদের মতো নেমে এসেছে ঘূর্ণিঝড়। আর তা নিয়ে নির্বাচন কমিশন যা করল, তাতে তৃণমূলের দ্বিতীয় নেটের জন্য গোলমুখ ওপেন করে দিল। এ ক্ষেত্রেও থ্রু-টা বাড়িয়েছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।
রাজ্যাপালের কোর্টে বল ফেলে তিনি বাউন্স করিয়ে নিয়ে এসেছেন।
উত্তরবঙ্গের ক্ষতিগ্রস্তদের বাড়ি তৈরির টাকা দেওয়ার জন্য অনুমতি চেয়ে কমিশনকে চিঠি দিয়েছিল রাজ্য সরকার। বুধবার নির্বাচন কমিশন রাজ্য সরকারের ওই আবেদন নাকচ করে দিয়েছে। অভিষেক জানান, নির্বাচন কমিশন রাজ্য সরকারকে জানিয়েছে, আংশিক ক্ষয়ক্ষতির টাকা রাজ্য সরকার দিতে পারবে। কিন্তু বাড়ি তৈরি করে দিতে পারবে না। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন ও কেন্দ্রীয় সরকারকে একযোগে আক্রমণ শানিয়েছেন তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কমান্ড।
দিল্লিতে নির্বাচন সদনে প্রতিবাদরত দলীয় প্রতিনিধি দলকে হেনস্থার প্রতিবাদে সোমবার রাতে রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোসের সঙ্গে দেখা করেন অভিষেকসহ তৃণমূল নেতৃত্ব। ওইদিনই তাঁরা দাবি জানিয়েছিলেন, ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে রাজ্য সরকার যাতে সাহায্য করতে পারে সেজন্য কমিশন অনুমতি দিক। আর রাজ্যপাল তাঁদের দাবির বিষয়টি কমিশনকে জানানোর আশ্বাস দিয়েছিলেন। সে ব্যাপারে কতদূর অগ্রগতি হল তা জানতে বুধবার সন্ধ্যেয় ফের অভিষেকের নেতৃত্বে তৃণমূলের প্রতিনিধি দল রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করে।
বৈঠক শেষে বেরিয়ে অভিষেক বলেন, '১৬০০ পরিবারের ঘর ভেঙে গিয়েছে। তাদের বাড়ি তৈরির জন্য টাকা রাজ্য সরকার দিতে চাইলেও সেই অনুমতি নির্বাচন কমিশন দেবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। কমিশন বলেছে, অল্প ক্ষয়ক্ষতির জন্য পাঁচ হাজার টাকা ও বেশি ক্ষয়ক্ষতির জন্য ২০ হাজার টাকা দিতে পারে রাজ্য সরকার।' এরপর মোদীকে নকল করে অভিষেক বলেন, 'না ঘর দুঙ্গা, না ঘর বানানে দুঙ্গা' - এটাই নতুন ভারতের বিজেপির মডেল।' অভিষেক সংবাদমাধ্যমের কাছে দাবি করেন, রাজ্যপাল এ ব্যাপারে কথা বলতে চেয়ে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব কুমারকে ফোন করেছিলেন।
কিন্তু কমিশনার কথা বলেননি। অন্য দুই নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে বলে রাজ্যপাল জানিয়েছেন। এই নিয়ে বিজেপিকে আক্রমণ করে তৃণমূলের সেনাপতি বলে, 'সাংবিধানিক পদমর্যাদা দিক থেকে রাজ্যপালের অনেক নীচে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার। কিন্তু বাংলার রাজ্যপালের ফোন উনি ধরছেন না! এটাই বিজেপির নতুন ভারত। এরা বাংলা বিরোধী নয়তো কারা বাংলা বিরোধী?'
অভিষেক আরো জানান, সম্প্রতি অসমে উৎসবের জন্য দু' হাজার ক্লাবকে দেড় লক্ষ করে টাকা দিতে অনুমতি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের তীব্র সমালোচনা করে অভিষেক বলেন, 'অসমের বিহু উৎসব চলার জন্য টাকা দিতে অনুমতি দিয়েছে কমিশন। এতে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু উৎসবের জন্য টাকা দেওয়ার অনুমতি দিলেও যাঁরা ঘূর্ণিঝড়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন, তাঁদের বাড়ি করে দেওয়ার টাকা দিতে দেবে না রাজ্য সরকারকে। অসমে বিজেপির সরকার তাই ওখানে নিয়মকানুন আলাদা! আর এখানে বাংলার মানুষ বিজেপিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাই গাত্রদাহ।'
তাঁর বক্তব্য, যে ১৬০০ পরিবারের ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে তাঁদের মধ্যে তো সব দলের ভোটার রয়েছেন। আগে তো তারা মানুষ। এবার এই গমক নিয়েই অভিষেক উত্তরবঙ্গে ভোট প্রচারে। দেখা করবেন ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর সঙ্গে। দ্বিতীয় গোলের জায়গাটা তৈরি করে ফেললেন অভিষেক। কেননা, নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা আর বিজেপি প্রার্থী ডা. জয়ন্ত রায়ের সাংসদ হিসেবে ভূমিকা। এই ভদ্রলোক আরএসএসের সদস্য। আরএসএস তাদের সব শক্তি নিয়ে নেমেছে। তবু স্বস্তিতে নেই বিজেপি।
তার প্রধান কারণ, জনসংযোগের নিরিখে প্রার্থী খুব দুর্বল। পাঁচ বছর সাংসদ ধাকলেও, ডা. জয়ন্ত রায়ের নাম মাঝেমধ্যে অনেকেই ভুলে যান। যে জেলায় শিক্ষার মান ঈর্ষণীয়, সেখানে এমন দুর্বল জনসংযোগ যথেষ্ট চিন্তার কারণ বইকি! যে কারণে জয়ন্ত রায়কে দল প্রথমটায় এবার প্রার্থীই করতে চায়নি। শোনা যায়, বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীও বেঁকে বসেছিলেন। কিন্তু তাহলে কে? যাঁকেই প্রার্থী করা হত, সূত্রের খবর, তিনিও আরএসএসের সদস্য।
ফলে বিদায়ী সাংসদকে বদল করে নতুন একজনকে সকলের সামনে আনাটা আরও চাপ তৈরি করত। এইরকমই একাধিক নাম নিয়ে আলোচনা প্রার্থী নিয়ে জেলার সিদ্ধান্তে বিজেপিকে বারবার পিছিয়ে দিচ্ছিল। যা তৃণমূলের সামনে অঢেল সুযোগ তৈরি করে রেখেছে। তবে বিজেপি প্রার্থীর এই জনসংযোগের ঘাটতির অন্যতম কারণ এলাকায় তাঁর ভালো মানুষ মিতভাষী পরিচিতি। একে ডাক্তার তায় সজ্জন ব্যক্তি। সজ্জন কথাটা চলে তৃণমূলের ধূপগুড়ির বিধায়ক তথা লোকসভার প্রার্থী নির্মল রায়ের ক্ষেত্রেও। কিন্তু তিনি আপাতত এগিয়ে ধূপগুড়ির স্মৃতি নিয়ে।
জলপাইগুড়ির গরিমার একটা ইতিহাস আছে। বহু যুগ ধরে বাণিজ্যের সঙ্গে তার যোগসূত্র, অন্যদিকে জল্পেশ মন্দির। শোনা যায়, একসময় ভালো গরম পোশাকের বাণিজ্য হত এই এলাকায়। পর্যটন শিল্প ও বনজ সম্পদের জন্য জলপাইগুড়ির একটা জায়গা আছে। তবে সম্প্রতি ময়নাগুড়ির ওপর বিধ্বংসী টর্নেডো জলপাইগুড়িকে ভোটের মুখে শিরোনামে এনে দিয়েছে । মাত্র ৪ সেকেন্ডে তার ধ্বংসলীলায় ক্ষতির মুখে পড়েছে প্রায় আড়াইশো মানুষ। যে ক্ষতে প্রলেপ দিতে তৃণমূল ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
প্রশ্নের মুখে পড়েছে বিজেপি ও এলাকার সাংসদ। ভোটের পর ৫ বছরে বিজেপি সাংসদ জেলার জন্য কোনও কাজ করেননি। মোদী সরকারও কোনও কাজ করেনি। তৃণমূল প্রশ্ন তুলেছে, আবাসের টাকাটা পেলে কাঁচা বাড়িতে থাকতে হত না। প্রাণ যেত না, এত ক্ষতি হত না। তাহলে বিজেপিকে কেন ভোট দেবে? মনে রাখতে হবে, ১৯৮০ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত জলপাইগুড়ি লোকসভা দখলে ছিল সিপিআইএমের।
তাদের হাত থেকে ২০১৪ সালে কেন্দ্রটি কেড়ে নেয় তৃণমূল। ২০১৯-এ আবার তা ছিনিয়ে নেয় বিজেপি। ১ লাখ ৮০ হাজারে জেতেন জয়ন্ত রায়। সেই আসনে ৫ বছর কোনও কাজ করেনি বিজেপি। ফলে বিজেপির দিকেই আঙুল উঠছে। এই পরিস্থিতিতে ধূপগুড়ির জয়ের ঘোড়াকেই বাজি ধরেছে তৃণমূল। সঙ্গে কৌশলী স্ট্র্যাটেজি সামনে এনেছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।
সম্প্রতি এখানে সভা করে বলে গিয়েছেন, যাকে ইচ্ছা ভোট দিন। শুধু বাড়ির জল, রাস্তা, এলাকার উন্নয়নের খতিয়ানটা দেখে নিন। আর দলকে নিদান দিয়েছেন বুথস্তরে সৈনিক সাজাতে, সেই পঞ্চায়েত ভোট থেকে। প্রধানমন্ত্রী সামনে রেখেছেন 'মোদীর গ্যারান্টি'। এখন দেখার ভগ্নমনা মানুষগুলো কার 'গ্যারান্টিতে আস্থা রাখেন, 'দিদি' না 'মোদী'?