দুরন্ত বার্তা ডিজিটাল ডেস্কঃ বাঙালির গোয়ান্দা মানে ফেলু মিত্তির, আর সত্যান্বেষী মানে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশ বক্সী। যার নেশায় আসক্ত আপামর বাঙালি সমাজ।
সালটা ১৯১৯ থেকে ১৯২১ সেই সময়েই ৬/৩ রামনাথ মজুমদার স্ট্রিটের প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং হাউসের ছোট এক কামরার ঘরেই হয়েছিল ব্যোমকেশের জন্ম ।১৯১৯ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় থাকতেন বইপাড়ার কাছের এই বোর্ডিং হাউসেই। এই সময়েই ব্যোমকেশ চরিত্রটি নিয়ে খসড়া লিখতে শুরু করেন সাহিত্যিক। শুরু হয় বাংলা সাহিত্যে ব্যোমকেশ, অজিত আর সত্যবতীর যাত্রা। প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং হাউসের দরজা এখন বন্ধ।
‘ব্যোমকেশের বাড়ি’র ঠিকানায় এখন রমরমিয়ে চলছে মহল হোটেল। তিনটি সিঁড়ি ভাঙলেই ছোট একটি কামরা, টিমটিম করছে আলো আর সেখানেই দুপুরের খাওয়া সারছেন কলেজের ছাত্রছাত্রী থেকে অধ্যাপক, বইপাড়ায় কেনাকাটা করতে আসা মানুষ থেকে মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তারবাবুরা। ঘড়িতে তখন দুপুর আড়াইটে। হোটেলের ভিতর আর জায়গা খালি নেই, চোখে পড়ল খাবারের জন্য হোটেলের বাইরে অপেক্ষারত মানুষের ভিড়।
সালটা ১৯১৭। নন্দলাল দত্ত তৈরি করেছিলেন প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং হাউস। কেবল থাকাই নয়, বোর্ডারদের জন্য খাওয়াদাওয়ারও ব্যবস্থা ছিল সেখানে। প্রথম থেকেই এই বোর্ডিং হাউসের রান্নার বেশ সুখ্যাতি। ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল সদস্য সংখ্যা। জীবনানন্দ দাশও এককালে থেকেছেন এই ঠিকানায়। আশির দশকে বন্ধ হয়ে যায় বোর্ডিং হাউস।
১৯৯১ সাল ঠাকুরদার বোর্ডিং হাউসের হেঁশেলেই ‘মহল হোটেল’ শুরু করেন সন্দীপ দত্ত। কলকাতাবাসী তো বটেই, বাংলাদেশের বাসিন্দাদের কাছেও বেশ জনপ্রিয় এই ভাতের হোটেল। সকাল সকাল বাজারের থলি হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন সন্দীপবাবু। কলেজ স্ট্রিট বাজার থেকে টাটকা মাছ, মাংস, আনাজপাতি সবটাই তিনি কিনে আনেন নিজে পরখ করে। মাছের গুণমানের সঙ্গে কোনও রকম আপস করতে নারাজ তিনি। শুক্তো, মুগের ডাল, মুড়িঘণ্ট, পোস্তর বড়া, মাছের ১৫ থেকে ২০টি পদ, দেশি মুরগির ঝাল থেকে কচি পাঁঠার ঝোল— বাঙালি হেঁশেলে যা যা পদ হয়, কমবেশি সবই পেয়ে যাবেন এই ঠিকানায়।
নব্বইয়ের দশকের ঐতিহ্য মেনে আজও এই হোটেলে কোনও মেনুকার্ড নেই। হোটেলে নেই কম্পিউটার ও , হিসাব সারা হয় কাগজেকলমেই। কোন চেয়ারের অতিথি কী কী খেয়েছেন, খাওয়াদাওয়ার শেষে দ্রুত লয়ে বিলিং কাউন্টারে বলতে থাকেন পরিবেশক। ৩০ বছর ধরে একই সুরে বলতে থাকায় মনে হয় যেন ছন্দোবদ্ধ কোনও গান।
এই হোটেলের মুড়িঘণ্ট, মাছের ডিমের বড়া আর জিরেবাটা, কাঁচকলা, আলু দিয়ে কাতলা মাছের ঝোলের স্বাদ অপূর্ব। ইলিশ ভাপা, ট্যাংরা মাছের রসা, চিতল পেটি কোর্মা, তপসে ফ্রাইয়ের স্বাদও অনবদ্য। নিরাশ হবেন না মাংসপ্রেমীরাও। বাঙালির প্রিয় আলু দেওয়া পাঁঠার মাংসের লাল ঝোল এবং চিকেন কষা এই হেঁশেলে রোজই মেলে। তবে অন্যান্য পাইস হোটেলের মতো শিলে বাটা মশলায় রান্না হয় না এখানে। তবে বাজারের গুঁড়ো মশলাও ব্যবহার হয় না এখানে, সমস্ত মশলা মিক্সিতে বেটেই ঝাল, ঝোল বানানো হয়। সারা বছর ধরে ইলিশ, চিতল, পাবদা, চিংড়ি মাছের কদর হলেও শীতকালে কিন্তু মহলে খিচুড়ি বেশ জনপ্রিয়। শীতের মরসুমে শনিবার করে গোবিন্দভোগ চালের খিচুড়ি করা হয়। সেই খিচুড়িতে পড়ে ফুলকপি, মটরশুঁটি আর দেশি ঘি!
বইপাড়ায় যাঁদের রোজ যাতায়াত, তাঁদের কাছে বাড়ির খাবার পৌঁছে দেওয়ার জন্য মহল চালু করার কথা মাথায় আসে কর্ণধারের। তাই এখানকার রান্নায় অতিরিক্ত তেলমশলা, ঝালের ব্যাপার নেই। একেবারে বাড়ির হেঁশেলের স্বাদ পাবেন মহলের রান্নায়।জায়গা সীমিত, তাই মহলে খাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে গেলে হাতে সময় নিয়ে যেতে হবে। তবে চিন্তার কিছু নেই, এখন মহলের খাবার মেলে সুইগি, জোম্যাটোতেও। শুধু তা-ই নয়, বিয়ের ভোজ রান্নারও দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে মহল।