১৮৯০ এর দশক। মহর বর্ণের অন্তর্গত একটি দরিদ্র বাড়ির ছেলেকে স্কুলে ক্লাসের বাইরে বসানো হয়েছিল, তাকে অন্যদের সঙ্গে বসতে দেওয়া হয়নি। তিনি প্রতিদিন বাড়ি থেকে স্কুলে বসার জন্য ব্যবহৃত তার আসনটি নিয়ে যেতেন। শুধু তাই নয়, তিনি জল খেতে চাইলে স্কুলের পিয়ন উঁচু থেকে তার হাতে জল ফেলে দিতেন। অবাক হচ্ছেন? এটাই সত্যি, এই দশকে এটি ছিল অস্পৃশ্যতার চরম স্তর। আর এই অস্পৃশ্যতার শিকার হয়েছিলেন ভারতীয় সংবিধানের জনক ডঃ বি.আর আম্বেদকর। আজ তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৫৬ সালের ৬ ডিসেম্বর তিনি মারা যান। প্রতি বছর এই ৬ ডিসেম্বর দিনটি 'মহাপরিনির্বাণ দিবস' হিসেবে পালিত হয়। বাবা সাহেবের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানোর জন্যই এই দিবস পালন করা হয়।
ডঃ ভীমরাও রামজি আম্বেদকর, যিনি বাবাসাহেব নামেও পরিচিত, ১৮৯১ সালের ১৪ এপ্রিল মধ্যপ্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর বাবার নাম রামজী শাকপাল। যিনি ছিলেন তৎকালীন পরাধীন ভারতের ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সুবেদার এবং তাঁর মাতার নাম ভীমাবাই।
বি. আর. আম্বেদকর জাতিতে ছিলেন মহর। যেই জাতিকে তৎকালীন ভারতের অস্পৃশ্য হিসাবে মানা হত। নিচু জাতির কোনও মানুষ ভুল করে উচু জাতির কোনও মানুষকে বা বস্তুকে স্পর্শ করলে তা অপবিত্র হিসেবে মানা হত। এমনকি তৎকালীন ভারতের এরকম জটিল পরিস্থিতিতে নীচু জাতির কোনও ছেলেই বিদ্যালয়ে পড়তে চাইতো না এবং বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও অপমান এবং খারাপ ব্যবহারের জন্য খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বিদ্যালয়ের পড়াশোনা ত্যাগ করতে হতো। এই সমস্ত কিছু অপমানকে সহ্য করেই তিনি এগিয়ে যান তাঁর জীবনের লক্ষে। প্রাথমিক শিক্ষার গন্ডি পেরোনোর পর তিনি এলফিনস্টোন উচ্চ বিদ্যালয়, এলফিনস্টোন কলেজ, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্সে পড়াশোনা করেছেন। ছাত্র হিসেবে অনেক বৃত্তি অর্জন করলেও তাঁর জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রাইভেট কোম্পানিতে অ্যাকাউন্টেন্ট হিসেবে কাজ করা শুরু করেন এবং পরবর্তীতে একটি ব্যবসাও শুরু করেছিলেন। তবে অস্পৃশ্য হওয়ার কারণে এগুলিতে তিনি খুব বেশি সফল হননি। পরে তিনি মুম্বইয়ের একটি কলেজে রাজনীতির অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন। ছাত্রদের মাঝে জনপ্রিয় হলেও নিচুজাতের কারণে সহ শিক্ষকদের দ্বারাও তাঁকে বৈষম্যের মুখোমুখি হতে হয়েছিল।
এই সবের কারণের জন্য আম্বেদকর প্রায়শই অস্পৃশ্যতা নির্মূল করার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করতেন। তবে শেষ পর্যন্ত ১৯২২ সালের মধ্যেই তিনি অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন। পরবর্তীকালে তাঁর জীবন ভারতবর্ষের সেবাতেই উৎসর্গ করেছিলেন। দলিত শ্রেণীর মানুষদের সামাজিক উন্নয়ন ও ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য বেশ কয়েকটি পুস্তক রচনা করেন, যা তৎকালীন ভারতীয় সমাজের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করে।
তফসিলি জাতি ও উপজাতির জন্য সংরক্ষণ ও রাজনৈতিক জীবন
১৯৩২ সালে ব্রিটিশ সরকার তথাকথিত নিম্ন বর্ণের মানুষদের জন্য পৃথক ভোটাধিকারের প্রস্তাব করেছিল। তবে, গান্ধীজি তখন ভেবেছিলেন যে এ জাতীয় পদক্ষেপে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ তৈরি হতে পারে। তাই তিনি আম্বেদকর ও মদন মোহন মালব্য এর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। দীর্ঘকালীন চিন্তাভাবনা ও আলোচনার পরে নিচুস্তরের মানুষদের জন্য কিছু আসনগুলি সংরক্ষিত রাখতে সফল হয়।
ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে আম্বেদকরকে প্রথম আইনমন্ত্রী হিসেবে আমন্ত্রিত করা হয়েছিল। তারপরে তাকে সংবিধানের খসড়া কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। সে কারণেই তিনি আজ ভারতীয় সংবিধানের জনক হিসেবে পরিচিত। সংবিধান নাগরিকদের পৃথকভাবে অধিকার ও কর্তব্যের নিশ্চয়তা দিলেও ডঃ আম্বেদকর সিভিল সার্ভিস, স্কুল ও কলেজগুলিতে তফসিলি জাতি ও উপজাতির জন্য আলাদাভাবে আসন সংরক্ষণের ব্যাবস্থা করেন। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে তিনি বেশ কয়েকটি বিতর্কিত বই প্রকাশ করেন।যার মধ্যে একটি ছিল "Thoughts on Pakistan" যেখানে তিনি মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার বিরুদ্ধে কঠোরভাবে সমালোচনা করেন। আম্বেদকর ভারতবর্ষকে এক আলাদা নজরে দেখতেন। তাই তিনি অবিচ্ছিন্ন ভারতবর্ষকে স্বাধীন হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন, যে কারণে ভারতকে দুই ভাগে ভাগ করার পক্ষের নেতাদের প্রকাশ্যে সমালোচনা করতেন।
আম্বেদকরের বৌদ্ধ ধর্মে রূপান্তর
১৯৫০ সালে তিনি বৌদ্ধ ধর্মের দিকে মনোনিবেশ করেছিলেন। ১৯৫৫ সালে তিনি ভারতীয় বৌদ্ধ মহাসভা প্রতিষ্ঠা করেন এবং তারপরে ১৯৫৬ সালে তিনি 'The Buddha and his Dhamma' গ্রন্থটি লেখা সম্পন্ন করেন।
আম্বেদকর ১৯৫৬ সালের ৬ ডিসেম্বর মারা যান। ১৯৯০ সালে তাঁকে মরণোত্তর ভারতরত্ন দেওয়া হয়েছিল। তাঁর স্মৃতিসৌধটি দিল্লির আলিপুর রোডে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জাতির সম্পদ আম্বেদকরকে তাঁর জন্মদিনে জানাই শতকোটি প্রণাম।