শান্তিনিকেতন: সাধারণত কাজ শেষ হয়ে যাওয়া কোনও স্মৃতিস্তম্ভকে ‘হেরিটেজ’ তকমা দেওয়া হয়। বিশ্বে প্রথমবারের মতো, একটি লিভিং বিশ্ববিদ্যালয় ইউনেস্কোর দ্বারা ঐতিহ্যের তকমা পেল ।
সৌদি আরবের রিয়াধে ইউনেস্কো-র ওয়র্ল্ড হেরিটেজ কমিটির বৈঠক হয় । ১০ সেপ্টেম্বর শুরু হয়েছে বৈঠক, চলবে ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। শনিবার সেখানেই শান্তিনিকেতনকে বিশ্ব ঐতিহ্য ক্ষেত্রের তালিকার অন্তর্ভুক্ত করা হল। রবিবার মাইক্রোব্লগিং সাইট এক্স–এ এই ঘোষণা করে ইউনেস্কো সেখানে লেখা হয়, 'ইউনেস্কো-র বিশ্ব ঐতিহ্য ক্ষেত্রের তালিকায় নয়া সংযোজন: শান্তিনিকেতন। ভারতকে অভিনন্দন'।
এই কাজের প্রথম উদ্যোগ শুরু হয়েছিল ২০১০ সালে। কিন্তু বেশ খানিকাটা এগিয়ে সেবার পিছিয়ে আসতে হয়। ফের ২০২০ সালে কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রক ও শিক্ষা মন্ত্রক যৌথ উদ্যোগে এই কাছে হাত দেয়। দায়িত্ব এসে পড়ে পুরাতত্ব বিভাগের উপরে। তৎকালীন ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের কোলকাতা মন্ডলের অধীক্ষক শুভ মজুমদারের তত্ত্বাবধানে কাজ শুরু হয়। তিন টি পর্বে ইউনেস্কোর নিয়ম অনুসারে প্রাথমিক ভাবে আবেদন জানায় ভারত সরকার। প্রথম টি শান্তিনিকেতন তথা বিশ্বভারতীর কোর এড়িয়া কে পৃথিবীর অন্যতম ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে কে মান্যতা দেওয়া হবে। তার জন্য ১৯ পাতার ডিজিটাল ব্রোসিওর তৈরি করে এএস আই। দ্বিতীয়ত কি ভাবে কি পদ্ধতিতে ঐতিহ্য স্থান তথা বাড়ি গুলির সংরক্ষণ হচ্ছে তার বিবরণ ও ছবি সম্বলিত ২৪ পাতার রিপোর্ট পাঠানো হয়। এবং তৃতীয়ত একটি ভিডিও ডকুমেন্টেটেশন পাঠানো হয় ইউনেস্কোর কাছে। প্রথম ভাবে আবেদন গৃহীত হবার পর ২০২১ সালের ১২ ডিসেম্বর শান্তিনিকেতনে প্রথম এসেছিল ইউনেস্কোর তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল।তাদের সামনে শান্তিনিকেতনের স্থাপত্য ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি কে তুলে ধরে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের স্বীকৃতি আদায়ে মরিয়া কেন্দ্রীয় সরকার ও বিশ্বভারতী। সেজন্যই ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের নজরদারি তে বিশ্বভারতীর ঐতিহ্য গৃহ, ভাস্কর্য গুলির আগেই সংস্কার শুরু করেছে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ।
যারা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের ক্ষেত্রকে মনোনয়ন করেন সেই ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল শান্তিনিকেতনে এসে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের বিভিন্ন স্থাপত্য ও ঐতিহ্যবাহী জায়গা ঘুরে দেখেন।
ইউনেস্কো প্রতিনিধি দলের সফরের আগেই কেন্দ্র সরকারের নির্দেশ মত শান্তিনিকেতন আশ্রম প্রাঙ্গনে যেসব স্থাপত্য আছে, সেগুলো রক্ষণাবেক্ষনের কাজ শুরু করেছে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া।ঐ দফতরের কলকাতা মন্ডলের সুপারেনটেনডেনট শুভ মজুমদারের তত্ত্বাবধানে ঐতিহ্যবাহী 'উপাসনা গৃহে'', ঘন্টা তলার সংরক্ষণের কাজ শুরু হয়।বর্তমানে ভারতীয় পুরাতত্ব বিভাগের মুম্বাই মন্ডলের অধীকষনক শুভ মজুমদার বলেন, "একটা দীর্ঘ লড়াই ছিল এই স্বীকৃতি অর্জনের ক্ষেত্রে। বিশ্বভারতীর মধ্যে যে কোর আশ্রম এড়িয়া রযেছে তার ঐতিহ্য, প্রাচীন কে গুরুকুল পদ্ধতির ধারা আজ ও বহমান তা এই স্বীকৃতি আদাযে সহযোগ দিয়েছে।"
প্রাথমিক অনুমোদন পর্বের পর এই প্রজেক্টের জন্য ডেসিযার তৈরির জন্য নির্দেশ দেওয়া হয় দুই স্থপতি কে। তারা হলেন আভা লম্বা ও মনীশ চক্রবর্তী। তারা দুজনে প্রায় ৩০০ পাতার ডেসিযার তৈরি করেন। যা অন্তিম পর্বে ইউনেস্কোর দপ্তরে পাঠানো হয়।
অবশেষে এল সেই মাহেন্দ্রযোগ। ওয়াল্ড হেরিজেটের তকমা পেতে চলেছে শান্তিনিকেতন বিশ্বভারতী। এই প্রথম বিশ্বের কোন লিভিং বিশ্ববিদ্যালয় এই তকমা পেলো । ইউনেস্কো-র তরফে মূলত সৌধ বা স্মৃতিস্তম্ভকেই হেরিটেজ তালিকায় রাখা হয়। এই প্রথম সক্রিয় অবস্থায় কোনও বিশ্ববিদ্যালয় সেই তালিকায় জায়গা পেল। খোলা আকাশের নীচে, মুক্ত বাতাসে শিক্ষাপ্রাপ্তিতে বিশ্বাসী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আজও সেই প্রথা চলে আসছে শান্তিনিকেতনে। ডেসিযার তৈরির দায়িত্বে থাকা সিস্টার নিবেদিতা বিশ্ব বিদ্যালয়ের আরকিটেকট বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মনীশ চক্রবর্তী বলেন, "এই স্বীকৃতি আসলে আজ থেকে ১০০ বছরের ও আগে রবীন্দ্রনাথের আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা দর্শন।"
প্রসঙ্গত ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন আবাসিক স্কুলের প্রতিষ্ঠা করেন। তার র ১৯২১ সালে বিশ্বভারতীর যাত্রার সূচনা। ১৯৫১ সালে বিশ্বভারতীর স্বীকৃতিলাভ। গোটা জীবনের সব অর্জন, সঞ্চয়ের আধার হিসেবে শান্তিনিকেতনকে ব্যাখ্যা করেছিলেন কবি। শান্তিনিকেতনকে রক্ষা করতে দেশবাসীর আদর ও যত্ন প্রয়োজন বলে মহাত্মা গাঁধীকে পাঠানো চিঠিতে লেখেন কবি।স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত এটি শুধুমাত্র একটি কলেজ ছিল এবং ১৯৫১ সালে একটি কেন্দ্রীয় আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটিকে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা দেওয়া হয়। এর প্রথম উপাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
এ বছর রবীন্দ্রজয়ন্তীতেই জানা যায়, ইউনেস্কো ওয়র্ল্ড হেরিটেজ সেন্টারের তরফে শান্তিনিকেতনের নাম সুপারিশ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রক এবং দেশের পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের তরফে সেই মর্মে আবেদন জানানো হয়েছিল।