‘হাল’, মানে চলতি এবং ‘খাতা’-র অর্থ হিসাবের বই। হালখাতা শব্দটা তৈরি হয়েছে এই দুটো আরবি শব্দ মিলে। অবিভক্ত ভারতবর্ষে মুসলিম শাসন আমলেই এই শব্দদ্বয় মিশে যায় বাঙালির জীবনে। রাত পোহালেই সেই হালখাতা। আধুনিকতার সাথে সাথে তার প্রকারভেদ হয়েছে, কিন্তু গুরুত্ব কমেনি।
হালখাতা শুরু হয় ব্রিটিশ শাসনকাল থেকে। বছরের প্রথম দিন জমিদারদের খাজনা দেওয়ার রেওয়াজ করেছিল ব্রিটিশরা। আকবরের সময়কাল থেকে এই খেরোর খাতা তৈরির কাজ শুরু হয়। এরপরে ব্রিটিশ শাসনকালে জমিদারদের খাজনার হিসেব নিকেশ করার জন্যে এই খাতা ব্যবহার করা হত। সেই সময়ে মূলত এই খেরোর খাতা তৈরি করা হত বাংলাদেশে। বাংলাদেশের শ্রমিকরা এই খেরোর খাতা তৈরিতে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন।
আগে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিকরা কলকাতায় এসে কাজ করতেন। বৈশাখ মাস পড়ার ছ মাস আগেই তাঁরা কলকাতায় চলে আসতেন। খেরোর খাতা কীভাবে বানাতে হয় কলকাতার শ্রমিকদের তা শেখাতেন তাঁরা। পয়লা বৈশাখের দিন সকালে স্বভূমে ফিরে যেতেন তাঁরা।
এখন কম্পিউটারে হিসেবশাস্ত্রর হাজারো প্যাকেজের সফটওয়্যার আছে। সেই জাবেদাখাতার প্রয়োজন আছে কি? হালখাতা এক অর্ধ-বিস্মৃত ট্র্যাডিশন হিসেবে বেঁচে থাকলেও খেরোর খাতার সঙ্গে বাঙ্গালির জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে আশেপাশের মানুষের সঙ্গে জুড়ে থাকার মানবিক টান।
খেরোর খাতা বাঙ্গালির প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা এক নস্টালজিয়া। ১লা বৈশাখ মা কালীর কাছে পুজো দেওয়া হয়। লক্ষী-গণপতির পুজা ও মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় । মূল কথা ব্যবসারে অর্থ উপার্জন।বস্তুত,খেরোর খাতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আপাদমস্তক বাঙ্গালিয়ানা। খাজাঞ্চিবাবুদের নস্যিটানা, নাকের থেকে ঝুলে থাকা পন্ডিতি চশমা, আর অসম্ভব মনোযোগের সঙ্গে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লিখে রাখা নিত্যদিনের হিসাব। খেরোর খাতা এক ইতিহাসের পান্ডুলিপি। বাঙ্গালির বিবর্তনের ইতিহাসের এক জ্বলন্ত প্রমাণ। যুগান্তরের সাথে সাথে বদলেছে খাজাঞ্চিবাবুদের ভোল।
তবে বাংলার ঐতিহ্য বাংলার আভিজাত্য কে উপলব্ধি করতে হলে, বাংলার এই প্রাচীন ঐতিহ্য ও রীতিনীতিকে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। তবে এই পুরাতনকে নতুনের সাথে সামজ্ঞস্য রেখে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদেরই। আমাদের নতুন প্রজন্ম কে এর গুরুত্ব ও ঐতিহাসিক মূল্য সম্পর্কে বোঝাতে পারলে,আমাদের যে সকল বস্তু বা রীতির সঙ্গে আমাদের আত্মার সম্পর্ক তা রক্ষা করা সম্ভব হবে।