
দূরন্ত বার্তা ডিজিটাল ডেস্ক: বিয়ে যেমন নিয়ে আসে একগুচ্ছ স্বপ্ন, ঠিক তেমনই মধুচন্দ্রিমা নিয়েও থাকে অনেক পরিকল্পনা ও কল্পনা। সঙ্গী পরিচিত হোক বা না-হোক—একান্ত সময় কাটানোর এই পর্বই দু’জনকে আরও কাছাকাছি এনে দেয়, আরও ভালভাবে চিনতে সাহায্য করে। আর যদি সেই পরিচয় এবং কাছাকাছি আসা প্রকৃতির মনোরম পরিবেশে হয়, তবে অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে হয়ে ওঠে আরও বিশেষ।
তবে বিয়ের প্রস্তুতি যতই আগে থেকে করা থাকুক, অনেক সময় ছুটির সীমাবদ্ধতা, বাজেটের হিসেব বা পারিবারিক নানা ব্যস্ততার কারণে আগেভাগে মধুচন্দ্রিমার পরিকল্পনা করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই কেউ কেউ শেষ মুহূর্তেই যাত্রার সিদ্ধান্ত নেন, আবার অনেকে ঠিক করতে পারেন না কোথায় গেলে সবচেয়ে ভালো হবে। আপনার সুবিধার্থে, ভারতে কাছের ও দূরের এমনই পাঁচটি আকর্ষণীয় গন্তব্যের ঠিকানা জেনে নিন।
* কালেজ ভ্যালি, দার্জিলিং: হিমালয়ের রানি দার্জিলিং। তবে মূল শহরের বাইরেও রয়েছে এমন অনেক স্থান, যা দিতে পারে নির্জনতা, প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্য। তেমনই এক স্থান কালেজ ভ্যালি। চা-বাগানকে কেন্দ্র করে পর্যটনের বিকাশ হয়েছে যে সমস্ত জায়গায়, তারই একটি হল কালেজ ভ্যালি। শোনা যায়, কালিজ় ফিজ়্যান্ট নামে এক সুন্দর দেখতে পাখির নাম থেকেই এমন নামকরণ।
তবে সেই পাখির দেখা মিলুক না মিলুক, কুয়াশামাখা পাহাড়, সবুজ চা-বাগিচা, পাহাড় ঘেরা উপত্যকা মন হারানোর জন্য আদর্শ। নির্জনতা থাকলেও পাহাড়ি হোম-স্টেগুলির কর্মীদের আতিথেয়তার উষ্ণতা কম নয়। কাছেই রয়েছে ইন্দ্রেনি ফলস। মেঘমুক্ত আকাশে ঝর্নার জলে সূর্যের আলো বিচ্ছুরিত হয়ে মেলে ধরে সাত রং। নেপালি ভাষায় ইন্দ্রেনির অর্থ ‘রামধনু’। অবশ্য ‘রেনবো ওয়াটার ফলস’ বলেই এই ঝর্না এখন পর্যটকদের কাছে পরিচিতি পেয়েছে। সেখানে পৌঁছতে খানিক হাঁটতে, খানিক সিঁড়ি বেয়ে নামতে হয়। অরণ্য ঘেরা সে প্থে হাঁটতে হাঁটতে সঙ্গীকে চিনে নিতে পারেন আরও নিবিড় ভাবে।
দার্জিলিং থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে এই স্থান যেন পর্যটকদের কাছে লুকোনো রত্নভান্ডার। নিকটতম বড়সড় লোকালয় বলতে রংবুল। সেখান থেকে জঙ্গল ঘেরা পাহাড়ি রাস্তা নেমেছে নীচে। রংবুল থেকে ৮-১০ কিলোমিটার দূরে এই কালেজ ভ্যালি। নিউ জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি বা বাগডোগরা বিমানবন্দর থেকে সরাসরি গাড়ি ভাড়া করে পৌঁছনো যায়। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে দূরত্ব বড়জোড় সাড়ে তিন ঘণ্টার। ছুটির দিন গোনাগুনতি হলে এই জায়গা বেছে নেওয়াই চলে। ইচ্ছা হলে জুড়তে পারেন ঘুম, দার্জিলিং।
* চন্দ্রভাগা সৈকত, পুরী: মধুচন্দ্রিমায় অনেকেরই পছন্দ পুরী। তার কারণ, দু'টি। প্রথমত যোগাযোগ ব্যবস্থা বেশ ভাল। অনেকে আধ্যাত্মিক টানে যান। বিয়ের পর পুজো দেওয়ার বাসনাও থাকে কারও। তবে পুরীতে প্রবল ভিড়ভাট্টা। তাই জগন্নাথ দর্শন করার পরেও, একটু নির্জনতার খোঁজ চাইলে চলে যেতে পারেন চন্দ্রভাগা সৈকতে। সৌন্দর্যে স্বর্গদ্বারের চেয়ে কম নয়, তবে এখানে পর্যটকদের ভিড় তুলনামূলক কম। পুরী থেকে কোণার্কের দিকে সমুদ্রের ধার বরাবর যে রাস্তা গিয়েছে, সেই মেরিনড্রাইভ রোড ধরেই সেখানে পৌঁছনো যায় চন্দ্রভাগা এবং রামচণ্ডী সৈকতে। কুশভদ্রা নদী যেখানে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে, সেখানেই রামচণ্ডী সৈকত। এখান থেকে ওয়াটার স্কুটারে চেপে পৌঁছতে পারেন বিস্তীর্ণ এক বালুচরে। তার এক দিকের জলে তেমন স্রোত নেই, কিন্তু অন্য পাড়ে সমুদ্র যেন সগর্জনে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। বালিতে ঘুরে বেড়ায় লাল কাঁকড়ার দল। কুশভদ্রা নদীর কাছেই রয়েছে দেবী রামচণ্ডীর মন্দির। মনে করা হয়, কোণার্কের সূর্য মন্দিরের চেয়ে রামচণ্ডী মন্দির পুরনো। স্থাপত্যের দিকে দিয়ে সেটি তেমন আকর্ষণীয় না হলেও, এটি ওড়িশার শক্তিপীঠ বলে পরিচিত। জায়গাটি পুরী থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে এবং কোণার্ক থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে। কোণার্ক এবং চন্দ্রভাগার আশপাশে নানা ধরনের হোটেল, রিসর্ট রয়েছে।
* জলিবয়, আন্দামান: মধুচন্দ্রিমার এ এক আদর্শ স্থান। সমুদ্রের জলের এতটা বর্ণময় রূপ— ভারতের অন্যত্র দেখা যায় কি না সন্দেহ! পাহাড়, অরণ্য, সাগর, কোরাল, মিউজ়িয়াম, সৈকত— সব নিয়েও এখানকার সৌন্দর্য। পোর্টব্লেয়ার, হ্যাভলক, নীল আইল্যান্ড আছেই— অতি অবশ্যই জুড়ে নিন জলিবয়। আন্দামানের সবচেয়ে সুন্দর জায়গার মধ্যে জলিবয় একটি। বছরে মাত্র ছ’মাস সেখানে পর্যটকদের যাওয়ার অনুমতি মেলে, তা-ও গুনে গুনে। প্রবাল দেখার সবচেয়ে ভাল জায়গা নিঃসন্দেহে জলিবয়। কাচের মতো স্বচ্ছ জল। দূষণ এড়াতে প্লাস্টিক নিয়ে যাওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
মহাত্মা গান্ধী মেরিন ন্যাশনাল পার্কের অন্তর্গত দ্বীপটি। ওয়ান্ডুর সৈকতের কাছেই একটি জেটি থেকে জলিবয়ের জন্য নৌকো ছাড়ে সকালে। খাঁড়িপথ দিয়ে যাত্রা শুরু। কত রকম যে পাখি ডেকে ওঠে আকাশছোঁয়া গাছের আড়াল থেকে! ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই পৌঁছনো যায় সবুজে ঘেরা সেই দ্বীপে। এখান থেকে ‘গ্লাস বটম বোটে’ প্রবাল, রঙিন মাছ দেখার অভিজ্ঞতা আজীবনের সঞ্চয় হয়ে থাকতে পারে। এখানেই দেখা মেলে ‘নিমো’ মাছ বা ক্লাউন ফিশের। পোর্ট ব্লেয়ারে থেকেই জলিবয়, সেলুলার জেল-সহ বেশ কয়েকটি দর্শনীয় স্থান দেখে নেওয়া যায়। জলিবয়ে থাকার কোনও ব্যবস্থা নেই।
* মুন্নার, কেরল: কেরলের পশ্চিমঘাট পর্বতমালার ৫২০০ ফুট উচ্চতায় মুন্নারে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে শুধু চা বাগানই নয় জলপ্রপাত থেকে শুরু করে নদী, নদীবাঁধ, ঝর্না, আয়ুর্বেদিক বাগান, টি-মিউজিয়াম, ফুলের বাগান, মশলার বাগিচা— সবই রয়েছে। সব মিলিয়ে শৈলশহর মুন্নার যেন সবার থেকে আলাদা। মুন্নারের সব থেকে ভাল দিক হল এটি শৈলশহর হলেও অসহনীয় ঠান্ডা পড়ে না। ডিসেম্বর, জানুয়ারিতেও মুন্নারের ঠান্ডায় স্নিগ্ধতার ছোঁয়া লেগে থাকে।
যাত্রা অবশ্য কোচি থেকে শুরু করাই ভাল। কোচি শহরে আরব সাগরের তীরে ফোর্ট কোচি, ডাচ প্যালেস, ইহুদিদের সিনাগগ, চাইনিজ় ফিশিং নেট ও অবশ্যই ফোকলোর মিউজ়ি য়াম ঘুরে দেখার। কোচিতে একটি দিন ঘোরার জন্য রাখলে ভাল। কোচি থেকে দুপুরে বেরিয়ে মুন্নার আসার পথে দেখে নেওয়া যায় ভারালা জলপ্রপাত। আট্টুকাল জলপ্রপাতও। মুন্নারের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে চা-বাগিচা। এখানে পাবেন স্থানীয় চকোলেট। দেখে নিতে পারেন পোথোমেডু ভিউ পয়েন্টে, মাত্তুপেট্টি জলাধার। আর যদি অরণ্য ভ্রমণের শখ থাকে, ঘুরে নিতে পারেন এরাবিকুলাম জাতীয় উদ্যান। ইদুক্কি, এরনাকুলাম জেলা জুড়ে বিস্তৃত বনভূমি বিপন্ন নীলগিরি তাহর এবং অন্যান্য অসংখ্য প্রাণী, প্রজাপতি ও পাখির আবাসস্থল।
* উদয়পুর, রাজস্থান: এই শহরের পরিচিতি 'হ্রদের শহর' নামে। আরাবল্লির সবুজ পাহাড় যেন বেড় দিয়ে রেখেছে হ্রদগুলিকে। আর সেই জলাশয় ঘিরেই তৈরি হয়েছে প্রাসাদ, মন্দির। ইতিহাস যদি ভালবাসা হয়, তবে মধুচন্দ্রিমার গন্তব্য হতেই পারে এই স্থান। প্রকৃতি-ইতিহাসের অদ্ভুত এক মেলবন্ধন রয়েছে এখানে। মধুচন্দ্রিমায় রাজকীয়তার স্বাদ চাইলে এই স্থান হল আদর্শ। বড় বড় দুর্গ, হাভেলি এখন হোটেল। সেখানে এখনও রাজকীয়তার ছোঁয়াচ রয়ে গিয়েছে। সজ্জনগড় মনসুন প্যালেস, অম্বরাই ঘাট, বাগোর কী হাভেলি-সহ অসংখ্য দর্শনীয় স্থান রয়েছে এখানে। পড়ন্ত বিকেলে হ্রদের ধারে বাঁধানো ঘাটে বসে সিটি প্যালেস, লেক প্যালেস দেখার অভিজ্ঞতাই আলাদা। রয়েছে উন্মুক্ত পরিবেশে সাজানো-গোছানো ক্যাফে। ঘাট ধরে হাঁটাও যায়। ক্যামেরাবন্দি করার জন্য এখান থেকে বহু জায়গাই মিলবে। আর গোধূলিবেলায় পিছোলা হ্রদে নৌকাবিহারের অভিজ্ঞতা আজীবনের সঞ্চয় হয়ে থাকতে পারে।
