Editorial

1 year ago

Sri Ramakrishna Paramahamsa : 'সবার চৈতন্য হোক' - সাধক রামকৃষ্ণের ১৮৭ তম জন্মদিনে আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য

Sri Ramakrishna Paramahamsa
Sri Ramakrishna Paramahamsa

 

 দুরন্ত বার্তা ডিজিটাল ডেস্কঃ  ১৮৩৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কামারপুকুরের এক দরিদ্র রক্ষণশীল পরিবারে রামকৃষ্ণ জন্মগ্রহন করেন। রামকৃষ্ণদেবের বাবা ছিলেন ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় ও মায়ের নাম ছিল চন্দ্রমণি দেবী। শোনা যায় চতুর্থ সন্তান রামকৃষ্ণ বা গদাধর জন্মানোর আগে রামকৃষ্ণের বাবা কিছু দিব্য স্বপ্ন দেখেছিলেন। ক্ষুদিরাম ছেলের জন্মের আগে গয়ায় গিয়ে বিষ্ণুকে দর্শন করেন। আর তাই তিনি ছেলের নাম রাখেন গদাধর। তিথির বিচারে এ বছর ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি রামকৃষ্ণ দেবের জন্মতিথি পালিত হচ্ছে আড়ম্বরের সঙ্গে সর্বত্র। কামারপুকুরে ভক্তের সমাগম চোখে পড়ার মতো। অন্যদিকে  দক্ষিণেশ্বর ও বেলুরমঠে আড়ম্বরের সঙ্গে মহাপুরুষ রামকৃষ্ণের জন্মতিথি পালন করা হচ্ছে। এই মহামানবের জন্মতিথিতে আমরা স্মরণ করবো তাঁর অমূল্য কিছু উক্তি। 

  সাধক রামকৃষ্ণ ছিলেন, সর্বধর্মের সমন্বয়ের প্রতীক। যে যুগে ধর্মের ও বর্ণের ভেদে সমস্ত পৃথিবীতে আসুরিক শক্তির বিকাশ ঘটেছিল,সেই যুগেই অবতার রূপে জন্ম নিয়েছিলেন সাধক রামকৃষ্ণ। তিনি নিজেই যীশুর সাধনা করেছেন, ইসলামের সাধনা করেছেন। তাঁর কথা থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগো ধর্ম সম্মেলনে হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করে ঐতিহাসিক বক্তৃতা দেন। বিবেকানন্দের বক্তৃতার মূল কথা ছিল, 'বহুত্ববাদীত্ব' - অর্থাৎ সমস্ত ধর্মী সত্য ও ঈশ্বরের কাছে পৌঁছনোর পথ। এটাই তিনি জেনেছিলেন, গুরু রামকৃষ্ণের 'যত মত,তত পথ' থেকে। সেই 'যত মত,তত পথ' এর ব্যাখ্যা দিয়ে রামকৃষ্ণ বলেছেন,

  ১) "সব ধর্মই সত্য। যে কোনও ধর্মের পথ ধরেই ভগবানের কাছে পৌঁছনো যায়। নদী বিভিন্ন পথ ধরে প্রবাহিত হয় কিন্তু সাগরে গিয়েই মেশে। এগুলো সবই এক।"

তিনি বলতেন,নারায়ণ সব প্রাণীর মধ্যে,সব মানুষের মধ্যে আছে। আবার এই মানুষের মধ্যেই আছে 'অসুর' ও 'দেবতা'। সঙ্গ করতে হবে ভালো মানুষের। খারাপ মানুষকে এড়িয়ে চলতে হবে। তা নাহলে ঈশ্বর সাধনা বিঘ্নিত হবে। ভালো-খারাপের মধ্য থেকেই 'ভালো'কে বেছে নিতে হবে। তাঁর উক্তি -

 ২) "চিনি আর বালি একসঙ্গে মিশিয়ে পিঁপড়ের কাছে রাখো। পিঁপড়ে ঠিক চিনি বেছে নেবে। একজন পবিত্র ও ধর্মপ্রাণ মানুষও খারাপ থেকে ভালো বেছে নেয়।"

 অহঙ্কার ও আমিত্ব মানুষকে নরকগামী করে। মানুষের মধ্য থেকে সমস্ত অহংকার দূর করতে হবে। এমন কি রামকৃষ্ণদেব একজন 'ব্রাহ্মণ'- এই বোধ মুহূর্তের জন্য হলেই তাঁর মধ্যে অহংকারের জন্ম দিয়েছিল। তাই তিনি 'পৈতে' ত্যাগ করেছিলেন। তিনি বলতেন -

 ৩) "অহঙ্কার না থাকলে জীবনে কোনও সমস্যাও থাকে না।"

  শিক্ষার কোনো শেষ নেই। অনেকেই পুঁথিগত শিক্ষাকে প্রকৃত শিক্ষা মনে করেন। কিন্তু ঠাকুর বলেন,মানুষের জীবনটাই হল 'পাঠাগার'। প্রত্যেকদিন জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে শিখতে হত। তাই জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের পাঠাগার থেকে শিক্ষা নিতে হয়।এই বিষয়ে তাঁর চিরস্মরণীয় উক্তি -

 ৪) "যতদিন বাঁচি, ততদিনই শিখি।"

  ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব ছিলেন একজন প্রকৃত সাম্যবাদী মানুষ। তাঁর শিক্ষাতেই বিবেকানন্দ বলেছিলেন, 'সমাজতন্ত্র আসবেই আসবে।' আর ঠাকুর তাঁর সরল ভাষায় অনেক আগেই বলেছেন '-

 ৫) "যখন তুমি ইশ্বরের কৃপা দৃষ্টি পাবে, সেই দৃষ্টি দিয়ে সবাইকে সমান মনে হবে। তখন ভালো-মন্দ আর উঁচ- নিচুর তফাৎ মুছে যাবে।"

  বিবেকানন্দ বলেছেন সত্যের জন্য সব ত্যাগ করা যায়,কিন্তু সত্যের জন্য কিছু ত্যাগ করা যায় না। স্বামীজির মনে এই বার্তা কিন্তু ঢুকিয়েছিলেন তাঁর গুরু রামকৃষ্ণদেব। তিনি বলতেন -

 ৬) "সত্যি বলতে ভয় পেলে চলবে না। সত্যের হাত ধরেই ঈশ্বর দর্শন হয়।"

  প্রত্যেক মানুষের মনেই থাকে একটা প্রকান্ড সূর্য। সেই সূর্যের আলোতেই তার মন আলোকিত থাকে। কিন্তু পরিস্থিতি,পরিবেশ ও অনুশীলনের অভাবের কারণে সে নিজের অন্তরস্থ সূর্যকে খুঁজে পায় না। তখন তাঁর মনে অন্ধকার বাসা বাঁধে। এই অন্ধকারের প্রধান কারণ তাঁর অহংকার। তিনি শিষ্যদের বলতেন -

  ৭) "সূর্য সারা পৃথিবীকে আলো আর উত্তাপ দেয়। কিন্তু ঘন কালো মেঘ যখন সূর্যকে ঢেকে দেয়, তখন সে আর আলো দিতে পারে না। সেরকমই আত্মঅহঙ্কার যখন মনের মধ্যে বাসা বাঁধে, তখন ঈশ্বরও আর দেখা দেন না।"

  নদী যেমন সাগরে পতিত হলে আর নদীর কোনো অস্তিত্ব থাকে না, ঠিক তেমনি মানুষ যদি ঈশ্বরের কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে তাহলে তাঁর আর নিজের কিছু থাকে না। তখন সব হয়ে ওঠে 'ব্রহ্মময়'। এই ভাবনাকে সরল ভাষায় তিনি বললেন - 

  ৮) "ঈশ্বরের চরণে নিজেকে সমর্পিত করলে মানুষের জীবনে আর কিছুই থাকে না।"

  রামকৃষ্ণের ধর্মপত্নী মা সারদা বলতেন 'যার মনে ভালোবাসা নেই সে আবার মানুষ কি!' এই মানবপ্রেমের বাণী প্রচার করেছেন যীশু থেকে চৈতন্যদেব সকলেই। সেই মানব প্রেমের কথা নিজের মতো করে বললেন সাধক রামকৃষ্ণদেব -

 ৯) "মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য হলো ভালোবাসা।"

রামকৃষ্ণদেবের সঙ্গে 'কল্পতরু' শব্দটি অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। তিনি বরানগরের বাড়িতে কল্পতরু হয়েছিলেন।মানুষ একবার কল্পতরু হলে সমস্ত ভুল,ত্রুটি,কালিমা মন থেকে একদম সরে যায়। তখনই মনে হবে 'মানুষ স্বয়ং ঈশ্বর'। তখন ঈশ্বরের কাছে শুধু 'ভক্তি' আর 'চৈতন্য' প্রার্থনা করা ছাড়া আর কিছু থাকে না। যখন ঠাকুরের 'কল্পতরু' হয়,তখন নাট্যকার গিরিশ ঘোষ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। উদ্বেলিত হয়ে গিরিশ ঘোষ সকলকে ডেকে বলেন, 'বাবা কল্পতরু হয়েছেন।' আসলে এই 'কল্পতরু' হলো সমস্ত মানুষের জন্য মহামানব রামকৃষ্ণের 'ভক্তি' ও 'চৈতন্য' প্রার্থনা করা। তিনি বলেছিলেন -

১০) "ঈশ্বরের কাছে তুমি ভক্তি চাইবে, আর এটাও চেয়ে নিও যেন কারও মধ্যে খুঁত না খুঁজে পাও।"

 ঠাকুরের জন্মতিথিতে আমরা প্রণাম জানাই ঠাকুরকে। জয় ঠাকুর,জয় রামকৃষ্ণদেব।


You might also like!