গত ৯ আগস্ট আরজিকর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসককে খুন ও ধর্ষণের ঘটনায় প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে গোটা রাজ্যে। সিবিআইয়ের অভিযোগ, কলকাতা পুলিশের জন্য ঘটনাস্থলে একাধিক ব্যক্তির প্রবেশের দরুন একাধিক তথ্য প্রমান লোপাট হয়েছে। সেই সঙ্গে মৃতা চিকিৎসককের পরিবারের দাবি, পুলিশ কিছুতেই মৃতাকে দেখতে দিতে চাইছিলেন না। আড়ালে পুলিশ নির্যাতিতার পরিবারকে টাকা দেওয়ার অভিযোগও করেছেন । জুনিয়র চিকিৎসক থেকে সাধারণ মানুষ, প্রত্যেকেই লালবাজারের দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। অনেকের দাবি, পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েল কোন রাজনৈতিক মদতে প্রকৃত সত্য গোপন করেছেন। এর ঘটনার নিরিক্ষে জুনিয়র চিকিৎসকরা পুলিশ কমিশনারকে মেরুদণ্ডের প্রতীকী তুলে দিয়েছেন। এর জন্য কলকাতা পুলিশের ভাবমূর্তি বলতে পারেন এককথায় তলানিতে। কিন্তু কলকাতা পুলিশ আদতে এত দুর্বল নয়! লালবাজারে একাধিক দুঁদে পুলিশ অফিসার রয়েছে।
কলকাতা পুলিশের সদর দপ্তর লালবাজার, যার নামের সাথে বহু দিনের ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে। কলকাতার যেখানে বিবাদী বাগ, তার উত্তর-পূর্ব কোণ থেকে বৌবাজার পর্যন্ত ছিল তৎকালীন ‘ক্যালকাটা’র এই রাস্তাটির ব্যাপ্তি। ইংরেজদের মতে রাস্তাটি ছিল ‘বেস্ট স্ট্রিট অফ ক্যালকাটা’। অনুমান করা হয় যে, বর্তমান লালবাজার এলাকায় সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের একটি কাছারিবাড়ি ছিল। দোলের সময়, লালদীঘি ও তার সংলগ্ন এলাকা আবির ও কুমকুমের রঙে লালবর্ণ ধারণ করত। সেই থেকেই লালবাজার নামকরণ, এমনই ধারণা অনেকের।
এই লালবাজারের প্রতিটি দেওয়ালে দেওয়ালে রয়েছে নানা ঘটনার রহস্য সমাধানের গল্প। তেমনি ১৮৯৭ সালের ১৬ আগস্ট অধুনা পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার কাঁঠালগুড়ি চা বাগানের ম্যানেজার হৃদয়নাথ ঘোষকে তাঁর বাংলোয় নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছিল। একাধিক তথ্য প্রমাণ পেয়েও আসল অপরাধীকে শনাক্ত করতে পারছিলেন না পুলিশ আধিকারিকরা। এই রহস্যময় ঘটনার তদন্ত করার জন্য প্রথমবার ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যুরো স্থাপন করা হয়েছিল। ১৮৯৭ সালের জুন মাসে কলকাতায় বিশ্বের প্রথম সরকারি ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যুরো স্থাপিত হয়, মূলত স্যার এডওয়ার্ড রিচার্ড হেনরি, খান বাহাদুর আজিজুল হক এবং রায় বাহাদুর হেমচন্দ্র বসু এই তিনজনের প্রচেষ্টার ফলে। বর্তমানে সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশনের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে রয়েছে এই দফতর।
এই লালবাজারে ছিলেন এক গোয়েন্দা। গল্পের ফেলুদা, ব্যোমকেশের রহস্যময় গল্পকেও হার মানতে বাধ্য করবে এর তদন্ত প্রক্রিয়া। তিনি হলেন প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়। তিনি ১৮৭৮ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ ৩৩ বছর এই বিভাগে কাজ করেন। তাঁর লিখিত “দারোগা প্রিয়নাথ” গল্পে একাধিক তুখড় তদন্তের প্রমান মেলে। শহরে অপরাধ সমাধানে তাঁর চমৎকার কৃতিত্বের জন্য ব্রিটিশ সরকার তাঁকে রায়বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করে।
শুধু ব্রিটিশ শাসনের জমানায় নয়, স্বাধীন ভারতেও একাধিক ঘটনার তদন্তে পুলিশকে বাস্তবের মাটিতে ফেলুদার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা গিয়েছিল। আইপিএস অফিসার সুপ্রতিম সরকার “গোয়েন্দাপীঠ লালবাজার” বইয়ে একাধিক ঘটনায় পুলিশের অসাধারণ তদন্তের কথা তুলে ধরেছেন।
তবে বর্তমানে পুলিশের তদন্তের দিক থেকে সাফল্যের ছবিটা কার্যত ধোঁয়াশার মধ্যে রয়েছে। ২০১৩ সালে ৭ জুন কলকাতা থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে উত্তর ২৪ পরগণা জেলার বারাসাত থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে কামদুনি গ্রামে ২০ বছর বয়সী এক কলেজ ছাত্রীকে অপহরণ, গণধর্ষণ এবং খুনের ঘটনা ঘটে। অপরাধীরা প্রমান লোপাটের জন্য ছাত্রীর পা নাভি পর্যন্ত ছিঁড়ে ফেলে, গলা কেটে তার লাশ পাশের মাঠে ফেলে দেওয়া হয়। এই কামদুনিকাণ্ডে প্রতিবাদের দাবিতে উত্তাল হয়েছিল গোটা বাংলা। এই ঘটনায় পরিবার পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। মৃতার বান্ধবী মৌসুমি কয়ালের অভিযোগ, পুলিশ আধিকারিক বিনীত গোয়েল একাধিক তথ্য প্রমান নষ্ট করেছেন। এর জন্য সিআইডি আসল তথ্য প্রমান পান নি। এর দরুন চার জন অপরাধী হাইকোর্টে বেকসুর খালাস পেয়ে যায়।
কামদুনিকাণ্ডের ১১ বছর পর আরজিকরে তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় আবারও সেই পুলিশ আধিকারিক বিনীত গোয়েলের তদন্ত নিয়ে উঠেছে গাফিলতির অভিযোগ।
এসবের উপর দোসর হয়েছে চুক্তি ভিত্তিক কিছু পুলিশ কর্মী যারা সিভিক ভলেন্টিয়ার নাম পরিচিত| অনেক ক্ষেত্রেই তাদের পুলিশ কর্মী হিসেবে কাজ করতে দেখা যাচ্ছে এবং পুলিশ বিভাগ অনেকটাই নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে তাঁদের উপর | এই আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ এবং আইনের পাঠ না জানা সিভিক কর্মীদের দল পুলিশের সার্বিক মান খারাপ করার পিছনে অনেকটাই দাই বলে মনে করছেন সংশিষ্ট মহল|
লালবাজারে একাধিক তাবড় তাবড় পুলিশ আধিকারিকেরা রয়েছেন, সেই সঙ্গে আছেন অভিজ্ঞ গোয়েন্দারা। তবে কেন এত গাফিলতির অভিযোগ? সত্যিই কি রহস্য সন্ধানে পুলিশ এখন দুর্বল?
নাকি রাজনৈতিক চাপের মুখে পুলিশ ভুলে গিয়েছেন তাঁদের দায়িত্ব ,কর্তব্য , মানবিকতা এমনকি তাঁদের ঐতিহ্য | তবে কি উঠে যাবে সেই প্রবাদ " বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা! পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ!! " চলে যাবে মানুষের মন থেকে পুলিশের প্রতি সম্ভ্রম , ভয় ও ভরসা ?
এমত অবস্থা একান্তই কাম্য নয়, অরাজকতা একান্তই কাম্য নয় কিন্তু সময় তো সাক্ষী আছে যখনি দুর্নীতি , অত্যাচার , অবক্ষয় গ্রাস করেছে সমাজকে তখনি জনগণ নেমে পড়েছেন রাজপথে আর প্রমান করেছেন যে তাঁরাই রাজার রাজা আর তাতে সামিল ও হয়েছেন পুলিশ , প্রশাসনের মানব সত্তা অধিকারী বহু মানুষ |
এক্ষেত্রে কি হবে | পুলিশ কি ফিরতে পারবে তার সেই পুরানো মহিমা নিয়ে ? কে দেবে সেই ফিরে আসার নেতৃত্ব ?
কোনো জননেতা কিংবা জনতা হয়তো বা পুলিশ নিজেই | বলতে পারবে শুধু মাত্র সময় |