সেখ আব্বােউদ্দিন : বাংলা চলচ্চিত্র, এই বিষয়ে গবেষণার কাজে ঘুরে বেড়াতে হয় বিভিন্ন জায়গায়। নানান মানুষকে বিরক্ত করি নানান প্রশ্নে। তেমনই একদিন কলকাতার হাতিবাগান এলাকায় পাকড়াও করি একদল তরুণকে। সিঙ্গল স্ক্রিন থিয়েটার নিয়ে কথা উঠলে বিড়ম্বনায় পড়ে তারা। তাদের মতে সিঙ্গল স্ক্রিন থিয়েটারে ফিল্ম দেখতে যাওয়া স্ট্যাটাসে আটকায়। তারওপর মাল্টিপ্লেক্সের মত ভালো ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়ারও সুযোগ নেই সিঙ্গল স্ক্রিন থিয়েটারে। এই তরুণ প্রজন্মের অধিকাংশই জানেন না এই সিঙ্গল স্ক্রিন থিয়েটারের সাথেই যুক্ত ছিলেন বাঙালি সাংস্কৃতিক আইকন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ এবং এই হাতিবাগানই একসময় পরিচিত ছিল 'সিনেমাপাড়া' হিসেবে। অবশ্য ওদের দোষ দিয়েও লাভ নেই। ওদের বেড়ে ওঠার আগেই হারিয়ে গিয়েছে নিয়ম করে প্রতি সপ্তাহে চলচ্চিত্র দেখার সংস্কৃতি। আর সিনেমাপাড়াও হারিয়েছে তার ঐতিহাসিক গৌরব।
গোটা হাতিবাগান এলাকায় ছিল মোট ১২টি সিঙ্গল স্ক্রিন থিয়েটার ছিল 'দর্পণা', 'মিনার', 'রুপবাণী', 'খান্না', 'বিধুশ্রী', 'পূর্ণশ্রী', 'স্টার', 'টাকী শো হাউস', 'রাধা', 'উত্তরা', 'শ্রী' ও 'মিত্রা'। তার মধ্যে শুধু বিধান সরণীতেই এক কিলো মিটারের মধ্যে ছিল ৮টি সিঙ্গল স্ক্রিন থিয়েটার। বর্তমানে এই ১২ টি থিয়েটারের মধ্যে 'বিনোদিনী' (স্টার) ও 'মিনার' মাত্র এই দুটি থিয়েটার সক্রিয় রয়েছে আর বাকি সমস্ত থিয়েটার বন্ধ হয়ে গেছে অথবা শপিং মল, চোখের চিকিৎসালয়, সোনার দোকান বা বসত বাড়িতে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। শুধু কলকাতা নয় ১৯৭০-৮০ এর দশকে ৭৫০-৯০০ সিঙ্গল স্ক্রিন থিয়েটার ছড়িয়ে ছিল গোটা বাংলা জুড়ে।
রুপবাণী'-র নামকরণ করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ 'রূপবাণী'-র উদ্দেশ্যে একটি শুভেচ্ছাবার্তা লিখে দেন-'রূপবাণীর প্রতি কবির আশীর্বাদ সার্থক হউক।' রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নটীর পূজা চলচ্চিত্রটি এখানে প্রথম মুক্তি পায়। সিনেমাপাড়ায় সবচেয়ে বিলাসবহুল থিয়েটার ছিল ৯৮৬ আসনসংখ্যার রুপবাণী। শুরু থেকেই এটি ছিল শীততাপ নিয়ন্ত্রিত। এখানে ছিল গাড়ি পার্ক করার আলাদা জায়গা, সুসজ্জিত বাগান এবং মহিলাদের জন্য বিশ্রামগৃহ। রুপবানীর দেওয়াল-চিত্র এঁকেছিলেন শান্তিনিকেতন কলাভবনের প্রথম চারজন ছাত্রের অন্যতম অর্ধেন্দুপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়।১৯৩২ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'চিররূপের বাণী' নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন।
এই কবিতায় চলচ্চিত্র ও 'রূপবাণী' নামকরণের সঙ্গে একটা সম্পর্ক যেন স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু এই উপলক্ষেই কবিতাটি লেখা হয়েছিল কিনা তার কোনো নির্দিষ্ট তথ্য চোখে পড়ে না। কবিতাটি শুরু হয় এইভাবে- 'প্রাঙ্গণে নামল অকালসন্ধ্যার ছায়া/ সূর্যগ্রহণের কালিমার মতো। উঠল ধ্বনি খোলো দ্বার!' কবিতাটি দীর্ঘ। শেষের দুটি : লাইনে কবি যা লিখলেন, তা যেন সবাক চিত্ররূপের প্রতি ইঙ্গিতবাহী- 'দেহমুক্ত রূপের সঙ্গে যুগলমিলন হল দেহমুক্ত বাণীর/ প্রাণতরঙ্গিনীর তীরে, দেহনিকেতনের প্রাঙ্গণে।' তবে সেই জৌলুস হারিয়ে গিয়েছে সময়ের গর্ভে। বর্তমানে এটি একটি চোখের চিকিৎসালয়ে পরিবর্তন হয়েছে।
উৎস: ফিল্ডওয়ার্ক, ২০২৪
উৎস: Bengal Film Archive
বাঁকুড়ায় নগেন্দ্রনাথ দত্ত নির্মিত থিয়েটারেরও উদ্বোধন করেন রবি ঠাকুর। ১৯৪০ সালের ২রা মার্চ সকালে বাঁকুড়ার জনগণ মধ্যযুগের বিখ্যাত কবি বড়ু চণ্ডীদাসের কবিতা শুনিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে স্বাগত জানায়। রবীন্দ্রনাথ বড়ু চণ্ডীদাসের সম্মানে থিয়েটারটির নামকরণ করেন 'চণ্ডীদাস চিত্র মন্দির'। ২০১৮ সাল থেকে এই থিয়েটারটি রুগ্ন হয়ে গেছে।
একসময় বাঁকুড়া টাউনের এক রাস্তায় ৩ টি সিনেমা হল ছিল- 'চন্ডীদাস', 'বীনা পানি' ও 'বাসন্তী'। পরবর্তী সময়ে এই রাস্তার নামই হয়ে যায় 'সিনেমা রোড'।
উৎস: ফিল্ডওয়ার্ক
১৯৩০ সালে বিএন সরকারের হাত ধরে পথ চলা শুরু করে হাতিবাগানে আর একটি সিঙ্গল স্ক্রিন থিয়েটার- 'চিত্রা'। যার উদ্বোধন করেছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। তিনি শর্ত দিয়েছিলেন তাঁর নিরাপত্তার জন্য কোন ব্রিটিশ পুলিশ মোতায়েন করা চলবে না। সেই শর্ত মেনে ওই দিন ভিড় সামলানোর দায়িত্ব দেওয়া হয় খেলার মাঠে হেডওয়ার্ড কোম্পানির লাইন ম্যানেজকারী ময়দানের দুর্ধর্ষ নিরাপত্তারক্ষী জব্বর আলিকে। নেতাজি ওই দিন আবেদন জানিয়েছিলেন বিদেশি ভাষা-নির্ভরশীলতা কমাতে।
নেতাজির উপদেশ মেনে গোড়া থেকেই 'চিত্রা'র টিকিট বাংলায় ছাপা হয়। প্রথম দিন 'চিত্রা'য় দেখানো হয় শরৎচন্দ্রের কাহিনী অবলম্বনে শ্রীকান্ত। ১৯৬৩ সালের ৫ এপ্রিল 'চিত্রা'র নতুন মালিক হন হেমন্তকুমার মিত্র, ফলে চিত্রার নাম বদলে হয় 'মিত্রা'। ২০০০ সালের গোড়ায় 'মিত্রা' নিজের ভোল পাল্টে ফেলেছিল, উন্নতমানের পুশব্যাক সিট, এসি চেয়ারের হাতলে জলের বোতল রাখার জায়গা, ৭.১ ডলবি সিস্টেম, সিমলেস প্রোজেকশন স্ক্রিন এইসব কিছু নিয়ে নতুনসাজে দর্শকের সামনে উপস্থিত হয়েছিল। প্রতিষ্ঠালগ্নে 'মিত্রা'র আসনসংখ্যা ছিল ১১৫৮ এবং শেষলগ্নে এর আসনসংখ্যা দাঁড়িয়ে ছিল ৮৩৪। কিন্তু আজ 'মিত্রা' কেবলই স্মৃতি। ২০১৯ সালের ১ এপ্রিল বন্ধ হয়ে যায় ঐতিহ্যবাহী এই থিয়েটারটি। এখানে শেষবার দেখানো হয় 'মুখার্জিদার বউ'। বর্তমানে সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে অত্যাধুনিক শপিং মল।
উৎস: ফিল্ডওয়ার্ক, ২০২৪ উৎস: Justdial.com
১৯৩১ সালে ১৭ ই সেপ্টেম্বর বীরেন্দ্রনাথ সরকার হিন্দি চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জন্য ধর্মতলা স্ট্রিটে গড়ে তুললেন 'নিউ সিনেমা'। এই থিয়েটারটির দ্বারোদঘাটন উৎসবের পৌরোহিত্য করেন সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। "জ্বলতি নিশান" ছিল নিউ সিনেমায় দেখানো প্রথম ফিল্ম। রবি ঠাকুর-শরৎচন্দ্র-নেতাজিদের মতো বাঙালি আইকনদের কল্যাণে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সিঙ্গেল স্ক্রিন থিয়েটার এবং চলচ্চিত্র ঢুকে পড়ে বাঙালির রোজকার জীবন সংস্কৃতির মধ্যে। কেমন ছিল সেই সিনেমা-সংস্কৃতি? উত্তর পেতে আবার ফিরে যেতে হবে হাতিবাগানে। মিস্টার ভট্টদেব সেনগুপ্তের (নাম পরিবর্তিত) কাছে। আনুমানিক দশ মিটার দূরত্বে থাকা দুই সিঙ্গল স্ক্রিন থিয়েটার 'শ্রী' ও 'উত্তরা'র মাঝে ছিল তাঁর মনোহারি দোকান। তাঁর কথায়, 'শুক্র, শনি ও রবি এই তিন দিন দুপুর এবং সন্ধ্যার শো-তে মেলার মতো ভিড় হতো। মেয়ে-বউরা বাড়ির কাজ শেষ করে পরিবারের সঙ্গে সিনেমা দেখতে আসতেন মূলত বিকাল বা সন্ধ্যার শো-তে।' এখন সেই জায়গায় বহুতল-শপিং মলের ভিড়। পুরানো স্মৃতির ভিড়ে চোখ ছলছল করে ওঠে ভট্টদেব সেনগুপ্ত।
বই, রেডিও ছাড়া চলচ্চিত্রই ছিল তখনকার দিনে একমাত্র বিনোদনের মাধ্যম। তাই প্রতি সপ্তাহে চলচ্চিত্র দেখা ছিল এক অলিখিত নিয়মের মতো। যেখানে পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে একসাথে দল বেঁধে চলচ্চিত্র দেখাই ছিল চল। সিঙ্গল স্ক্রিন থিয়েটার গুলিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল ওই সমস্ত এলাকার অর্থনীতি।
হাতিবাগান এলাকায় বেড়ে ওঠা অধ্যাপিকা রিয়া সেন (নাম পরিবর্তিত) সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে উঠে আসে সিনেমা দেখার ক্রেজ। নস্টালজিয়ায় হারিয়ে তিনি শোনালেন, 'ছেলেবেলায় আমরা পাঁচ ভাইবোন নিয়ম করে প্রতি সপ্তাহে সিনেমা দেখতে যেতাম। যখন জেঠু মারা গেলেন, পরিবারে নেমে এল শোকের ছায়া। সেই শোক ভুলতেই আমরা ভাই-বোনেরা বাড়িতে কাউকে না জানিয়েই গেলাম সিনেমা দেখতে। পরে বাড়ির বড়রা জানতে পেরে খুব বকেছিলেন।' অল্প বয়সের পাগলামির কথা মনে করে নিজেই হেসে ওঠেন মিস রিয়া সেন।
আমি গত দুই বছর গবেষণা করার সূত্রে লক্ষ্য করেছি যে কলকাতার মধ্য বয়স্ক ও বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেই 'সিনেমাগোয়িং' এর ক্ষেত্রে 'কালচারাল মেমোরি' নিয়ে বেঁচে আছেন। এই অভিজ্ঞতা স্থান, কাল এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে, যা স্থানীয় সংস্কৃতিকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে। 'লিটারেসি' শব্দটা বহুল প্রচলিত হলেও 'সিনেমাসি' কথাটা সচরাচর শোনা যায়না। সিনেমা হলে যে কেউ যেতে পারেন এবং একজন নিরক্ষর মানুষও নিজের মত করে চলচ্চিত্র বোঝার ক্ষমতা রাখেন। হয়তো বোঝার ক্ষেত্রে তারতম্য হতে পারে। এই নিবন্ধের প্রথমদিকে বলেছিলাম যে বিনোদন গ্রহণের ক্ষেত্রে দর্শকের মধ্যে একটি শ্রেণী ভেদাভেদ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করার সূত্রে কিছু মানুষের সাথে আলাপচারিতায় উঠে আসে যে বর্তমানে এমন এক শ্রেণীর দর্শক রয়েছেন তাঁদের কাছে পর্যাপ্ত টাকা থাকা সত্বেও মলের মধ্যে মাল্টিপ্লেক্সে গিয়ে চলচ্চিত্র তাঁরা দেখায় আগ্রহী নয়। আবার এমন অনেক মানুষ রয়েছেন যাদের পক্ষে তিনশো টাকার টিকিট কেটে মাল্টিপ্লেক্সে চলচ্চিত্র দেখতে যাওয়ার সামর্থ্য নেই। এবং এমন এক শ্রেণীর যুব দর্শক রয়েছেন, যাঁরা মনে করেন সিঙ্গল স্ক্রিন থিয়েটারে চলচ্চিত্র দেখতে যাওয়া ভদ্র সমাজের জন্য অনুমোদিত নয়। মাল্টিপ্লেক্স সংস্কৃতি, ওটিটি সংস্কৃতি, ভিডিও হল, অর্থনীতি ও জনরুচির তীব্র বদলে, এই সিঙ্গল স্ক্রিন থিয়েটারগুলির অধিকাংশই বন্ধ হয়ে গিয়েছে অথবা পরিবর্তে শপিং কমপ্লেক্স, আবাসিক ভবন, অফিস বা বহুতুল হয়ে গিয়েছে। তবে আমার মনে হয় আগামী দিনে 'কালচারাল স্টাডিজ' এর গবেষণার ক্ষেত্রে আভাঁ-গার্দ শ্রেণীর গবেষকরা তৎকালীন বাংলার সিনেমা হলের 'মুভিগোয়িং' ও 'চলচ্চিত্র প্রদর্শনী' ব্যবস্থাকে লেখালেখি ও আলোচনারমধ্যে দিয়ে সংরক্ষণ করবেন।
তথ্যঋণ:
সোনার দাগ: গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ (যোগমায়া প্রকাশনী, ডিসেম্বর ১৯৮২)
রবীন্দ্র রচনাবলী: জন্মশতবার্ষিকী সংস্করণ (পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ২৫ বৈশাখ ১৩৬৮)
কলকাতার সিনেমা হল পটভূমি ও ইতিবৃত্তান্ত: সুজয় ঘোষ (অরণ্যমন প্রকাশনী, সেপ্টেম্বর ২০২০)
'সিনেমা পাড়া' হাতিবাগান: মৌনি মণ্ডল, ১১ মে, ২০২১, বঙ্গদর্শন
'সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি': শিবাজীপ্রতিম বসু ১ এপ্রিল, আনন্দবাজার পত্রিকা।
'বাংলা চলচ্চিত্রের বিষয়-আশয়': সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় ২০শে ফেব্রুয়ারী, ২০২১, Itihasadda.com