কেন্দ্রীয় সমীক্ষায় দেখতে পাওয়া গিয়েছে যে অধিকাংশ বাংলার তরুণীরা ঘরকন্নায় ব্যস্ত। তাদের চাকরি নেই, লেখা পড়ার করার ইচ্ছা থাকলেও উপায় নেই, আর্থিক সামর্থ্য নেই। ফলে ঘরে কাজ ছাড়া এই তরুণীরা বাইরে কোনও কাজ করতে পারছে না। তবে তার মধ্যে দুই একজন মানসিক শক্তি সম্বল করে ঘর থেকে বাইরে এসে কাজ করছে এবং উপার্জন করছে, তবে সেটা হাতে গোনা নাম মাত্র। তার বাইরে আর কিছুই নয়, কিন্তু অধিকাংশ তরুণীরা ঘরে বসে বাবা মায়ের কথা মতো সংসারের কাজ করছে, মাকে রান্নায়় সহযোগিতা করছে, ঘরদোর পরিস্কার করছে,অধিকাংশ মেয়েরা পড়াশুনা করছে না। তাদের পড়ার মানসিকতা তৈরি করতে ঘরের কোনও অভিভাবকেরা এগিয়ে আসছে না,তার ফলে বেকার জীবন যাপন করতে শুরু করেছে বাংলার অধিকাংশ তরুণীরা, হাতের কাজের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে না, উচ্চাকাঙ্খা একেবারে উবে গিয়েছে। সমানে দিকে এগিয়ে চলার কোনও রাস্তা ঘুঁজে বের করতে পারছে না। এরা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ঘরের কাজকর্ম করে সময় অতিবাহিত করছে।
কেন্দ্রের এক সমীক্ষা করতে গিয়ে দেখা গিয়েছে , পড়াশুনা প্রশিক্ষণ কোনও কিছুর মধ্যে তারা নেই, এই সব অধিকাংশ মেয়েদের বয়স হচ্ছে ১৫ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে। বাংলার ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্প কন্যাদের জীবনকে উন্নতি করার পথ দেখাতে পারেনি, আসলে হাতের কাজ করা বা পড়াশুনার করার ওপরে প্রশাসন বেশি করে চাপ দেওয়ার কথা ভাবেনি, কীভাবে মেয়েরা স্বনির্ভর হয়ে উঠবে তার কোনও ব্লু্প্রিন্ট তৈরি করতে পারেনি, ‘কন্যাশ্রী’র মতো ভাতা দিয়ে কিন্তু মেয়েদের জীবনকে উন্নত করা সম্ভব হয়নি। সমীক্ষা বলছে,মেয়েদের পড়াশুনার করানোর ব্যাপারে বাড়ির অভিভাবকেরা একেবারে উদাসীন ছিল। তার ফলে মেয়েরা বড় হয়ে ঘরে বাইরে পা রাখার ক্ষমতা দেখতে পারেনি।
উত্তর প্রদেশ, গুজরাত, ওড়িশা এবং আসমের মতো রাজগুলির অবস্থা পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে খারাপ। কোভিডের ধাক্কায় স্কুল জীবন থেকে সরে গিয়েছে বহু ছাত্রছাত্রীরা।তারা এখন ঘরে বসে কাজ করছে বা তাদের অধিকাংশদের বিবাহ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখতে পাওয়া গিয়েছে স্কুল পড়ুয়া মেয়েদের বিবাহ দিয়েছে তাদের পরিবারের বাবা মায়েরা। তার ফলে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে পারেনি বহু মেয়েরা । তাদের স্কুল জীবন নবম শ্রেণি বা অষ্টম শ্রেণির মধ্যে পড়াশুনা সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল| নিজেদের ইচ্ছা থাকলে তারা কিন্তু পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারেনি পরিবারের অভিভাবকদের অসহযোগিতার কারনে। কন্যাশ্রী প্রকল্পের টাকা মেলায় বহু মেয়েদের বিবাহ দিয়ে দেওয়া হয়েছে,পরিসংখ্যান করে দেখতে পাওয়া গিয়েছে যে গোটা দেশে অল্প বয়সের মহিলাদের বিবাহের হার পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে বেশি পশ্চিমবঙ্গে একশো জনের মধ্যে প্রায় ৪৫ জনের বেশি মেয়েদের বিবাহ হয়ে গিয়েছে একুশ বছর পার হওয়ার আগেই, অথচ কন্যাশ্রী প্রকল্পের মাধ্যমে বাল্যবিবাহ কমানোর কথা চিন্তা করা হয়েছিল।
কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবার মন্ত্রক একটি সমীক্ষা প্রকাশ করেছে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সমীক্ষা চালু রাখার কথা ছিল,কেভিড পরিস্থিতির কথাকে মাথায় রেখে তা সময় সীমা বৃদ্ধি করা হয়। ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সমীক্ষা চালু রাখা হয়েছিল। সেখানে দেখতে পাওয়া গিয়েছে যে প্রায় ২৯.৩ শতাংশ ১৫-২৪ বছরের মেয়েরা কেনও রকম ভাবে পড়াশুনা বা প্রশিক্ষণ নেওয়ার সঙ্গে যুক্ত নয়,তারা স্রেফ বেকার হয়ে ঘরে বসে রয়েছে। এর মধ্যে ছেলেদের হার ১৬.১ শতাংশ ও মেয়েদের হার ৪৩.৮ শতাংশ।
পশ্চিমবঙ্গে এই রকমের ছেলেদের হার ১৭.৭শতাংশ এবং মেয়েদের হার ৪৯.৯ শতাংশ। যার অর্থ বাংলার অধিকাংশ মেয়েরা কোনও কাজ না করে ঘরে বসে রয়েছে। সংখ্যাটা গ্রামে বেশি করে উপলব্ধি করা গিয়েছে,সেখানে ৫২.৩ শতাংশ মেয়েরা বেকার হয়ে ঘরে বসে রয়েছে, ঘরের কাজ করছে, চাষবাসের কাজে বাবার সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে।দেখতে পাওয়া গিয়েছে এই সব মেয়েরা সংসারের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাবা মায়ের সহযোগী হিসাবে কাজ করছে।এছাড়াও দেখা গিয়েছে মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করার আগেই বহু মেয়েদের বিবাহ দিয়েছে তার পরিবারের লোকজনে, আবার করোর কারোর বিবাহ হয়ে গিয়েছে অষ্টম শ্রেনির পাশ করারর পরই। বাবা মায়েরা কন্যার খরচ বহন করতে একেবারে অপারগ ছিলেন,সেই কারণে তারা প্রায় জোর করেই ঘরের মেয়েদের বিবাহ দিয়ে দায় মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছে। কন্যাশ্রী প্রকল্প যে উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরি করা হয়েছিল সেখানে দেখতে পাওয়া গেল সেই সব মহৎ উদ্দেশ্য একেবারে তিরোহিত হয়ে গিয়েছে। ২৫ হাজার টাকা পাওয়াটা বড় হয়ে দেখা দিতে শুরু করে দিয়েছিল পরিবার পরিজনদের কাছে। এর সঙ্গে এলাকার দাদাদের কাটমানি ছিল কিনা তাও খতিয়ে দেখতে শুরু করে দিয়েছে পর্যবেক্ষকেরা বিয়ের নাম করে ২৫ হাজার টাকা পুরো বিবাহে খরচ করা হয়েছিল কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানতে পারা গিয়েছে।
কোনও পড়ুয়া মেয়েকে স্কুল ছাড়িয়ে বিবাহ দেওয়াটাকে সমাজ জঘন্য অপরাধ বলে গণ্য করলেও তাকে বাধাা দেওয়ার তো কেউ ছিল না। সময়ে সময়ে পুলিশ খবর পেয়ে তৎপর হলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখতে পাওয়া গিয়েছে অধিকাংশ স্কুল পড়ুয়া মেয়েরা মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার আগেই স্বামীর ঘর করতে চলে গিয়েছে, ফলে মেয়েদের সামনের দিকে তুলে দাঁড়ানোর কথা যেভাবে প্রচার করা হচ্ছিল তা কিন্তু সার্থক হতে পারেনি। কোভিড পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষা জগতে একেবারে পঙ্গু করে দিয়েছিল সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ইউরোপের দেশগুলিতে মেয়েরা অত্যন্ত সচেতন, তার ফলে সেখানে কোভিড মহিলাদের বেশি করে আঘাত দিতে পারেনি বা তাদের জীবনকে পঙ্গু করতে পারেনি, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে মেয়েদের অবস্থা ছিল একেবারে কাহিল। তারা পরনির্ভরশীল জীবন যাপন করে থাকে, বাবা মায়ের ওপরে তাদের জীবনযাত্রা নির্ভর করে। তার ফলে বাবা মা যা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে একেবারে ফেলে দিতে পারে না। বাবা মায়ের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে ঘর থেকে বের হয়ে এসে কোথাও ঠাঁই পায় না। তার ফলে তারা একেবারে অসহায় বোধ করতে থাকে। এর ফলে দেখতে পাওয়া গিয়েছে শিক্ষা গ্রহণ করতে আগ্রহী মেয়েরা অনিচ্ছাকৃত বিবাহকে গ্রহণ করছে। বহু ক্ষেত্রে দেখতে পাওয়া গিয়েছে যে শ্বশুর বাড়ির লোকেরা পড়াশুনা করার প্রলোভন দেখিয়ে মেয়েকে বাড়ির বৌ করে নিয়ে গিরে একটি ঘরে প্রায় বন্দি করে রেখে দিয়েছে। সংসারের কাজকে সামাল দিতে সেই সব মেয়েদের সময় কেটে যাচ্ছে। পড়াশুনার করার কোনও অতিরিক্ত সময় বের করতে পারছে না, তার ফলে তাদের যে পড়াশুনার করার ইচ্ছা ছিল তা একেবারে ইতি হয়ে গিয়েছে।
ফলত বাংলায় মেয়েদের শিক্ষিতের হার ক্রমশ কমতে শুরু করেছে। বহু ছেলেরা আবার রাজ্যে চাকরি না পেয়ে তারা অন্য রাজ্যে গিয়ে শ্রম দিতে শুরু করেছে, ফলে সেখানেও স্কুল জীবনের ইতি হয়়ে গিয়েছে। এবারে মাধ্যমিক পরীক্ষায় চার লক্ষ ছাত্র পরীক্ষায় কম বসেছে, এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোভিড সংক্রমণ ব্যবসায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করলেও দেখতে পাওয়া গেল শিক্ষার ক্ষেত্রে কোভিড কিন্তু বহু ক্ষতি করে দিয়েছে। স্কুল যাওয়ার প্রবণতাকে হ্রাস করেছে, পরীক্ষা দেওয়ার প্রবণতাকে হ্রাস করেছে, অনলাইন পড়াশুনার ওপরে জোর দেওয়ার ফলে স্কুলে উপস্থিতির হার উল্লেখযোাগ্যভাবে কমতে শুরু করেছে। ছাত্র অভাবে পশ্চিমবঙ্গের প্রায় চার হাজার স্কুল তুলে দেওয়ার কথা ভাবতে শুরু করেছে প্রশাসন। সেখানে দেখতে পাওয়া গিয়েছে বহু স্কুলে ছাত্রদের উপস্থিতির হার ক্রমশ তলানির দিকে যাচ্ছে। স্কুল যাওয়ার প্রবণতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমতে শুরু করেছে। ঘরে বসে পড়াশুনার ওপরে আগ্রহ প্রদর্শন করতে শুরু করেছে ছাত্ররা।
এদিকে আবার বহু শিক্ষকেরা তারাও অনলাইন পাঠ করানোর দিকে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। স্কুলে গিয়ে সময় নষ্ট না করে ঘর থেকে বসে ডিজিটাল পদ্ধতি গ্রহণ করে লেখাপড়া চালু করার দিকে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, স্কুল খোলার পক্ষে এই শিক্ষকেরা সায় দিতে পারছিল না। কিন্তু শিক্ষা দফতর স্কুল খোলার ওপরে বেশি করে জোর দেওয়ার ফলে বাধ্য হয়ে এই সব শিক্ষকোরা একেবারে নিমরাজি হয়ে স্কুলে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। এখন তো মিড ডে মিলের ওপরে বেশি করে ঝোঁক বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে, বহু ছাত্ররা শুধু মিড ডে মিল খেতে স্কুলে যায়।তারা কোনও পাঠ গ্রহণ করতে স্কুলে আসে না, মিড ডে মিল খাওয়ার পরে স্কুলের আবার পড়াশুনার পরিবেশ তৈরি করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। স্কুল শুরু হওয়ার মাত্র কয়েকটি ক্লাসের সিরিয়াস পড়াশুনা হয়, তারপরে মিড ডে মিলের ঘন্টা পরলে স্কুলে ছুটি ছুটি ভাব এসে উপস্থিত হতে থাকে।
বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলিতে এই রকম পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার ফলে এখন আর কোনও সিরিয়াস ক্লাস হয় না। তার ফলে বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলি এখন ধুঁকতে শুরু করে দিয়েছে। এদিকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলি রমরমা করে চলছে, সেখানকার আইনশৃঙ্খলা এখনও বাংলা মাধ্যম স্কুলের মতো একেবারে ভেঙে পড়েনি, মিড ডে মিল খাওয়ার মতো কোনও পরিবেশ সেখানে তৈরি হয়নি, সেখানে একটি শৃঙ্খলিত স্কুল জীবন এখনও দেখতে পাওযা যায় যা অতীতে বাংলার মাধ্যম স্কুল গুলিতে ছিল। সেই শৃঙ্খলাবদ্ধ বাংলা মাধ্যম স্কুলের সংখ্যা ক্রমশ কমতে শুরু করেছে। পুরসভার প্রাথমিক স্কুলগুলি এখন কেবল মাত্র সাইনবোর্ড হয়ে রয়েছে, তার শরীরে কিন্তু রক্ত মাংস নেই, জীবনী শক্তি একেবারে কমে গিয়েছে। ফলে ৱুনিয়াদী শিক্ষা বা প্রাথমিক শিক্ষা প্রায় উঠে গিয়েছে। অতীতে টোল শিক্ষার ওপরে উচ্চ শিক্ষা নির্ভর করতো, এখন সেটাকে কেটে ফেলে দেওয়া হয়েছে, তার ফলে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করার সংখ্যা ক্রমশ কমতে শুরু করেছে। দুই একজন ছিটকে গিয়ে মেধা শক্তি নিয়ে নিজেদের উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের উপযুক্ত তৈরি করছে বটে, তা দিয়ে তো রাজ্যের শিক্ষার পরিবেশের সুস্থতার প্রমাণ পাওয়া যায় না।শিক্ষা ক্ষেত্রে যে ধরনের একের পর এক দুর্নীতি বাসা বেঁধে ছিল সেখান থেকে শিক্ষাকে মুক্ত করা খুব একটা সহজ হবে না। শিক্ষার পরিবেশকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসতে গেলে প্রায় আরও কয়েক বছর পার হয়ে যাবে, সেই সময় পর্যন্ত সবাইকে অপেক্ষা করতে হবে। এছাড়া আর কোনও বিকল্প পথ খোলা নেই।