দুরন্তবার্তা ডিজিটাল ডেস্ক: সম্প্রতি ইরানের পরমাণু কেন্দ্র নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহলে চাঞ্চল্য ছড়ালেও, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রাথমিক রিপোর্টে জানানো হয়েছে—ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ধ্বংস হয়নি। বরং কিছু নির্দিষ্ট প্রযুক্তিগত ক্ষয়ক্ষতির কারণে তাদের কার্যক্রম কয়েক মাস পিছিয়ে গিয়েছে মাত্র। এই তথ্য মার্কিন প্রশাসনের একাধিক সূত্র থেকে উঠে এসেছে বলে দাবি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর।
ইরানের তিনটি পরমাণুকেন্দ্র ফোরডো, নাতান্জ় এবং ইসফাহানে হামলা চালিয়েছিল আমেরিকার সামরিকবাহিনী। ওই হামলার পরে কতটা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা নিয়ে ইতিমধ্যে একটি প্রাথমিক রিপোর্ট তৈরি করে ফেলেছেন আমেরিকার গোয়েন্দারা। ওই গোপন রিপোর্ট সম্পর্কে ওয়াকিবহাল একাধিক আধিকারিকের সূত্রে ‘নিউ ইয়র্ক টাইম্স’ জানিয়েছে, হামলায় দু’টি পরমাণুকেন্দ্রের প্রবেশপথ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ভূগর্ভস্থ ভবনগুলিকে ধ্বংস করা যায়নি। প্রাথমিক ভাবে রিপোর্টে এমনটাই জানানো হয়েছে।
আমেরিকার হামলার আগে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলি মনে করছিল, ইরান যদি পরমাণু বোমা বানানোর জন্য খুব তাড়াহুড়ো করে, তা হলেও তিন মাস সময় লাগতে পারে। পরমাণুকেন্দ্রে হামলার পরে মার্কিন সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে অনুমান করা হচ্ছে, এই হামলায় ইরানের পরমাণু কর্মকাণ্ডকে পিছিয়ে দেওয়া গিয়েছে। তবে খুব বেশি সময়ের জন্য নয়। খুব বেশি হলে ছ’মাস পিছিয়ে দেওয়া গিয়েছে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি।
তা ছাড়া আমেরিকা হামলা চালানোর আগেই সমৃদ্ধ ইউনেরিয়াম ইরান অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে বলেও সন্দেহ করা হচ্ছে ওই রিপোর্টে। ফলে তিন পরমাণুকেন্দ্রে হামলার ফলে ইরানের পারমাণবিক দ্রব্যাদির খুব সামান্যই ধ্বংস হয়ে থাকতে পারে। বাকি সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামকে ইরান বিভিন্ন গোপন আস্তানায় সরিয়ে ফেলেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে রিপোর্টে।
ইরানে সামরিক অভিযান চালানোর পর থেকেই ডোনাল্ড ট্রাম্প দৃঢ়ভাবে দাবি করে আসছেন, হামলায় ইরানের তিনটি পরমাণু কেন্দ্র সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়েছে এবং সেটিকে তিনি "সফলতা" হিসেবেই তুলে ধরেছেন। গত কয়েক দিনে একাধিক বার তিনি একই বক্তব্য পুনরায় প্রকাশ করেছেন, এমনকি তাঁর প্রশাসনও এই দাবিকে সমর্থন করেছে। তবে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সাম্প্রতিক প্রাথমিক রিপোর্টে ট্রাম্পের এই অবস্থানের সঙ্গে স্পষ্ট বিরোধ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গোয়েন্দারা বলছেন, প্রকল্প ধ্বংস হয়নি, বরং সাময়িকভাবে কয়েক মাস পিছিয়ে গিয়েছে। কিন্তু এই মূল্যায়নকে ঘিরে ট্রাম্প কোনওভাবেই নিজের অবস্থান থেকে সরে আসেননি। বরং ট্রুথ সোশ্যালে পোস্ট করে তিনি জানিয়েছেন, ইজরায়েল ও ইরান—উভয় পক্ষই যুদ্ধ থামাতে চেয়েছিল, এবং সব পারমাণবিক কেন্দ্র ধ্বংস করে যুদ্ধ বন্ধ করাটা তাঁর কাছে এক বিশেষ সম্মানের মুহূর্ত ছিল। হোয়াইট হাউসও তাঁর এই বক্তব্যে সমর্থন জানিয়েছে। গোয়েন্দা রিপোর্টকে তারা "সম্পূর্ণ ভুল" বলে উড়িয়ে দিয়েছে। শুধু ট্রাম্প প্রশাসন নয়, ইজরায়েলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচও সেই রিপোর্ট মানতে নারাজ। তাঁর মন্তব্য, এখনই কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত টানা সম্ভব নয়, প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র জানতে সময় লাগবে। এতে স্পষ্ট, রাজনৈতিক ও গোয়েন্দা মূল্যায়নের মধ্যে গভীর বিভাজন তৈরি হয়েছে।
‘নিউ ইয়র্ক টাইম্স’-এর এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে আরও ভিন্নস্বর। মার্কিন প্রশাসনের একাংশ মনে করলেও যে ইরানের পরমাণু প্রকল্প পুরোপুরি ধ্বংস হয়নি, অন্য একটি অংশের মতে, হামলায় তিনটি পরমাণুকেন্দ্রই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে—কোথাও বড়, কোথাও মাঝারি মাত্রায়। বিশেষ করে নাতান্জ় কেন্দ্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট আধিকারিকেরা। যদিও এই কেন্দ্রগুলিকে পুনরায় গড়ে তোলার জন্য ইরান কোনও পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে কি না, তা নিয়ে এখনো স্পষ্ট ধারণা মেলেনি।
এই সঙ্গে ইজরায়েলি গোয়েন্দা মহলে সন্দেহ জোরাল হয়েছে যে, ইরান হয়তো আরও কিছু গোপন ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র গড়ে তুলেছে, যেগুলি ছোট আকারের ও নজরের বাইরে। মূল কেন্দ্রগুলি আঘাতপ্রাপ্ত হলেও যাতে গোটা কর্মসূচি সম্পূর্ণভাবে থেমে না যায়, সেই কারণেই ইরান এই বিকল্প পরিকাঠামো তৈরি করে থাকতে পারে বলে তাঁদের অনুমান।
উল্লেখযোগ্যভাবে, পাঁচ পাতার ওই গোপন মার্কিন গোয়েন্দা রিপোর্টটিকে আপাতত "শুধু একটি প্রাথমিক মূল্যায়ন" বলেই বর্ণনা করছেন ওয়াশিংটনের উচ্চপদস্থ আধিকারিকেরা। তাঁদের মতে, এটি কোনও চূড়ান্ত বিশ্লেষণ নয়, এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও তথ্য উঠে এলে প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে। ফলে ইরানের পরমাণু প্রকল্প নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে যে দ্বিধা ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, তা এখনই মিটছে না—বরং ধীরে ধীরে তা আরও গভীর তদন্তের দিকে এগোচ্ছে।