Editorial

1 year ago

Editorial বর্তমান সময় ও বাংলা ভাষার গতিপথ: রবীন্দ্র কুমার শীল

International Mother Language Day
International Mother Language Day

 

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের দিন ঘটা করে প্রভাত ফেরী করে বাংলার  জয়গান গাই আমর| বাংলার ভাষার হয়ে পদযাত্রা করে নিজেদের ঐতিহ্যকে বহাল রাখতে সচেষ্ট হই আমরা|শুধু তাই নয়, ঘটা করে স্কুল কলেজে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের বাংলার গান, নাটক মঞ্চস্থও করে থাকি| কিন্তু তার সুফলটা কি পাওয়া যায়? বাংলা কি সত্যিই তাদের আগেকার স্থানে পেঁছাতে পেরেছে? উনবিংশ শতাব্দী বা অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাংলা ভাষা নিয়ে যেভাবে চর্চা হতো আজকে ভারত স্বাধীনতা লাভ করা পর বাংলা ভাষার চর্চা কি আরও বৃদ্ধি পেয়েছে? বর্তমান সময়ে দেখা গিয়েছে আজকের চেয়ে পরাধীন ভারতে বাংলা ভাষার চর্চার চল ছিল অধিক। তার একটি মাত্র কারণ হচ্ছে তৎকালীন পণ্ডিতেরা ইংরেজি ভাষার পরিবর্তে বাংলা ভাষাকে প্রাধান্য দিইয়েছিলেন অধিকতর| তাঁরা বাংলা ভাষার শ্রীবৃদ্ধির জন্য সংগ্রাম করেছিলেন| 

বাংলা ভাষার কৈলিন্যকে উচ্চ মার্গে নিয়ে যেতে অনেক মুনি ঋষিগন ই তৎপর হয়েছিলেন, ৎবে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন পণ্ডিত ঈশ্বরচদ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়| তিনি বাংলা ভাষার স্কুল স্থাপন করেছিলেন| কলকাতা শহরের বুকে তাঁর হাতে গড়া তিনটি মেট্রোপলিটান স্কুল রয়েছে যেখানে বাংলা চর্চা করা হতো| তা বলে কিন্তু ইংরেজি শিক্ষা বন্ধ করে দেওয়া হয়নি| বাংলা ছিল প্রথম পত্র আর ইংরেজি ভাষা ছিল দ্বিতীয় পত্র| বাংলা ছাত্রছাত্রীদের অতি অবশ্যই ইংরেজি পড়তে হবে এবং শিখতে হবে|

বাংলা ভাষার ছাত্রদের ইংরেজি ভাষা শেখার অতি সহজ পুস্তক রচনা করেছিলেন প্যারী চাঁদ মিত্র| তিনি ইংরজি ভাষা শিক্ষার ফার্স্ট বুক রচনা করলেন| বিদ্যাসাগর বাংলা শেখার জন্য সহজ পাঠ্য পুস্তক রচনা করেছিলেন| শুধু বাঙালিরা নয়, বহু সাহেবরাও বিদ্যাসাগরের এই পাঠ্য পুস্তক পড়ে বাংলা ভাষার শিক্ষা নিয়েছিলেন| বাংলার ভাষার উন্নতির জন্য কাজ করে গিয়েছিলেন মদনমোহন তর্কালঙ্কার মহাশয় যিনি বিদ্যাসাগরের বন্বু ছিলেন| বন্বু বিদ্যাসাগরের সঙ্গে পরে মদনমোহন তর্কালঙ্কারে ঝগড়া হলেও তাদের বন্বুত্ব কিন্তু অটুট ছিল| বিদ্যাসাগর আবার মদনমোহনের বিধবা স্ত্রী এবং মেয়েকে মাসিক ভাতা দিতেন| তখন তারা একেবারে আর্থিক কর্পদক শূন্য হয়ে গিয়েছিলেন| বন্বু মদনমোহন তর্কালঙ্কার বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহকে সমর্থন করেছিলেন| এবং বিধবা বিবাহ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন| তার ফলে বিদ্যাসাগরের একটা অনুরাগ কাজ করত মদনমোহনের প্রতি| 

এঁদের আগে রাজা রামমোহন রায় বাংলা ভাষা চর্চার প্রথম সোপান রচনা করে গিয়েছিলেন| তাঁর পথকে অনুসরণ করে বিদ্যাসাগর এবং মদনমোহন এগিয়ে চলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে| এরপরে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়,বিলাত থেকে উপস্থিত হলেন বিপ্লবী অরবিন্দ| তিনি বরোদাতে এসে বাংলা এবং সংস্কৃˆত শিক্ষা গ্রহণ করলেন| এদিকে ভগিনী নিবেদিতা বাংলা ভাষা শিখে বাংলার মহিলাদের উন্নতির কাজে অংশ গ্রহণ করতে শুরু করলেন| তিনি বাগবাজারে মেয়েদের জন্য একটি স্কুল তৈরি করেছিলেন| সেখানে বাংলা ভাষা এবং ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি হাতের কাজ শেখানো হতো যাতে মহিলারা স্বালম্বী হতে পারে| ভগিনী নিবেদিতা স্বয়ং সেই স্কুলে তদারকি করতেন| 

বাংলার বিপ্লবীদের পাশে এসে দাঁড়ালেন কবি কাজি নজরুল এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর| তিনি আবার ১৯০৫ সালে বাংলা ভাগের বিরোধিতা করে রাস্তায় নেমে পড়েˆ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুললেন| বাংলাকে ভাগ করা চলবে না| তখন কিন্তু ভারতে এসে উপস্থিত হয়ে গিয়েছেন বিপ্লবী অরবিন্দ| কিন্তু তিনি তখন বাংলায় এসে উপস্থিত হননি| তিনি তখন বরোদাতে রয়েছে| বিপ্লবী অরবিন্দকে বাংলায় নিয়ে এসেছিলেন ভগিনী নিবেদিতা| তিনি বলেছিলেন অরবিন্দকে বাংলা এবং সংস্কৃˆতি ভাষা শিখতে| না হলে বাংলার সঙ্গে মেলামেশা করা একেবারে অসম্ভব হবে| এদিকে রবীন্দ্রনাথ বাংলাকে ভাগ করার চক্রান্ত রুখতে দুটো গান রচনা করে ফেললেন|একটি গান হলো-‘ বাংলার বায়ু বাংলার জল বাংলার ফুল বাংলার ফল’ | আর একটি গান- ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি|’ এই দুটো গান বাংলার জনগণকে মাতিয়ে দিল| 

তার ফলে বাংলা ভাগ বিরোধী আন্দোলন মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করলো| সেই বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকে একেবারে থামানো অসম্ভব হয়ে পড়তে শুরু করে দিয়েছে| ইংরেজরাও প্রমাদ গুনলেন|তারা বুঝতে পারলেন যে আর কলকাতায় ভারতের রাজধানি রাখা সম্ভব হবে না| বাংলা ইংরেজ শাসক বিরোধিতায় করতে শুরু করে দিয়েছে| 

কলকাতা থেকে দিল্লিতে রাজধানি গিয়ে উপস্থিত হল| ইতিমধ্যে ১৯১১ সালে মোহনবাগান আইএফএ শিল্ড জয়লাভ করলো ইংরেজ সেনাদের পরাজিত করে| প্রথম স্বদেশি দল আইএফএ শিল্ড জয়লাভ করলে সারা বাংলা জুড়ে তার বিজয় উৎসব দেখতে পাওয়া গিয়েছিল| ইংরেজরা ক্রমশ ভীত হতে শুরু করে| তার ফলে কলকাতা থেকে দিল্লিতে রাজধানি নিয়ে চলে যাওয়া হল| এতে ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন বিপ্লবী রাস বিহারী বোস| তিনি দিল্লিতে উপস্থিত হয়ে লর্ড হার্ডিঞ্জের ওপরে বোমা নিক্ষেপ করে গা ঢাকা দিলেন| তার ফলে আরও ইংরেজরা সতর্ক হয়ে উঠল| 

এই পরিস্থিতিতে বাংলা ভাষার চর্চা আরও বৃদ্ধি পেতে শুরু করে| বাংলা ভাষায় পত্র পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে| এ রুপ পরিস্থিতিতে ইংরেজ সরকার বাংলার ভাষার পত্র পত্রিকাগুলির ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করে| তার ফলে বহু বাংলা পত্রিকা প্রকাশ করা একেবারে অসম্ভব হয়ে পড়ে| অমৃত বাজার পত্রিকা আগে বাংলায় প্রকাশিত হতো|ইংরেজদের বাংলা ভাষার পত্রিকা প্রকাশের ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করলে তখন রাতারাতি অমৃত বাজার পত্রিকা ইংরজি ভাষায় প্রকাশিত হতে শুরু করে| 

বাংলার ভাষার চর্চার ওপরে সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি করে এমনভাবে বাংলা ভাষাকে কোনঠাসা করে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছিল যাতে করে অতি সহজেই কেউ বাংলা ভাষা চর্চা না করতে পারে| কিন্তু তৎকালীন বাংলার মনীষীরা মাতৃভাষার চর্চার ওপরে বেশি করে জোর দিতে শুরু করে দিয়েছিলেন| তাঁরা বলতে শুরু করলেন বাংলা ভাষাকে শিখতে হবে নিজেদের আত্মমর্যাদাকে রক্ষা করতে| ইংরেজি ভাষাকে শিখতে হবে আধুনিক সভ্যতাকে চিনতে এবং জানতে| বাংলা ভাষা চর্চাকে বন্ধ করে রাখলে চলবে না| বাংলা ভাষা হচ্ছে স্বদেশি ভাষা| আর ইংরেজি ভাষা হচ্ছে ঔপনিবেশিক ভাষা| ইংরেজি ভাষা এসেছে কেরানি তৈরি করতে| আর বাংলা ভাষা হচ্ছে মনের ভাষা| হৃদয়ের ভাষা| একে ত্যাগ করা চলবে না| 

তারপরেও আমরা কি দেখতে পেলাম! ভারত স্বাধীনতা লাভ করার পর| ইংরেজরা ভারত ছেড়ে চলে গিয়েছে| কিন্তু তাদের দাসত্ব করার ভাষাকে দিয়ে গিয়েছে|সেটাই এখন বাংলার জনপ্রিয় ভাষায় পরিণত হয়েছে| আর বাংলা ভাষা ক্রমশ বিলীন হবার পথে এগিয়ে যেতে শুরু করে দিয়েছে| ব্রিটিশ ভারতে বাংলা ভাষার চর্চা বৃদ্ধি লাভ করেছিল| আর স্বাধীন ভারতে ইংরেজি ভাষার চর্চার উপর বেশি করে জোর দেওয়া| তার ফলে মাতৃভাষার অপমৃত্যু ঘটার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে| স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তিতে এটাই বাংলা ভাষার বর্তমান রুপরেখা|  

You might also like!