হঠাৎই দুর্বল লাগছে? সঙ্গে মাথা ঝিমঝিম বা বুক ধড়ফড়? অল্পেতেই হাঁপিয়ে পরছেন?
Anemia decease and its cure by nutritionist Dr. Reshmi Roychowdhury
দুরন্ত বার্তা ডিজিটাল ডেস্কঃ মানবশরীরে রক্তে লোহিত রক্তকণিকা
বা হিমোগ্লোবিনের(Hemoglobin) পরিমাণ কমে গেলে তাকে অ্যানিমিয়া বলা হয়। অ্যানিমিয়া প্রতিরোধে সঠিক
খাদ্যাভ্যাস বিশেষ জরুরী। ক্যানসার, ডায়াবেটিসের মতো
তলে তলে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে রক্তাল্পতার সমস্যা। সাধারণত দেশে-বিদেশে মহিলারা
এই অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতা রোগের শিকার হন। হিমোগ্লোবিন হল রক্ত কণিকায়
অবস্থিত একপ্রকার প্রোটিন, যার মধ্যে আয়রন ও ট্রান্সপোর্টস অক্সিজেন থাকে। কিন্তু রক্তে
হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কমে গেলে রক্তের অক্সিজেন বহনের ক্ষমতা কমে যায়, ফলে কোষের প্রয়োজনীয়
ও পরিমাণ মতো অক্সিজেন পৌঁছতে পারে না। এতে সেই মানুষটি অল্পেতে হাঁপিয়ে পড়েন, বুক
ধড়ফড় করে।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার(WHO) সমীক্ষা
অনুযায়ী ৬ মাস থেকে ৬ বছর বয়সী শিশুদের হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ১১ শতাংশের কম, ৬ বছর
থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুদের হিনোগ্লোবিনের পরিমাণ ১১ শতাংশের কম। ১৫ বছরের বেশী বয়সী
ছেলেমেয়েদের হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ১২ শতাংশের কম, ১৫ বছরের বেশী বয়সী পুরুষদের হিমোগ্লোবিনের
পরিমাণ ১৩ শতাংশের কম, গর্ভবতী মহিলাদের হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ১১ শতাংশের কম হলে তাকে
অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতা বলা হয়।
পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের
সব থেকে বড় সমস্যা অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতা। ১ থেকে ৬ বছর বয়সী শিশু, কিশোরী, যুবতী
মহিলা, গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েরা সব থেকে বেশী আক্রান্ত হন রক্তাল্পতায়। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে
প্রজননক্ষম মহিলাদের মধ্যে ৬২ শতাংশ, গর্ভবতী মহিলাদের মধ্যে ৭০ শতাংশ, ১ থেকে ৬ বছর
বয়সী শিশুদের ৬৮ শতাংশ, প্রসূতি মায়েদের ৭৪ শতাংশ রক্তাল্পতায় ভুগছে। ফলে তারা স্বাভাবিক
কাজকর্ম ও স্বাভাবিক প্রোডাক্টিভিটি দিতে পারছে না।
রক্তাল্পতা বা অ্যানিমিয়া প্রতিরোধ(Cure of Anemia):
রক্তাল্পতা বা অ্যানিমিয়া
প্রতিরোধে প্রত্যেক মানুষের প্রধান অস্ত্র হবে সঠিক খাদ্যাভ্যাস যার প্রধান উদ্দেশ্য
থাকবে পর্যাপ্ত পুষ্টি শরীরে প্রবেশ করানো। তার প্রথমিটি হল আয়রন সমৃদ্ধ খাবার যুক্ত
দৈনন্দিন আহার। - আয়রন সমৃদ্ধ সবজি থাকুক
প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায়। যেমন --- লাল শাক, নটে শাক, কুলেখাড়া, সজনে শাক, শাপলা,
ফুলকপির ডাঁটা, গাজর, কচু, কচুর লতি, পালংশাক, বিট, ধনে পাতা, এই শাক সবজিগুলোতে আয়রণের
পাশাপাশি ফলিক অ্যাসিড আছে, যেগুলো রক্তের হিমোগ্লোবিন বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। ডাল - যে কোন রকম ডাল রক্তাল্পতা দূর করতে অনবদ্য। তাই প্রতিদিন
মসুর, মুগ, মাসকলাই ডাল খাওয়া দরকার। কারণ এই খাবারে প্রচুর ফোলেট পাওয়া যায়। ফোলেট
রক্তের হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ঠিক রাখতে সাহায্য করে। তাই ফোলেট সমৃদ্ধ খাবারে অভ্যস্ত
হতে হবে যে কোন বয়সীর অ্যানিমিক রোগীকে। ডিম - সুষম আহারের মধ্যে ডিম
একটি বিশেষ উপাদান। ডিমের মধ্যে রয়েছে প্রোটিন ও অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট। রক্তাল্পতা
কমিয়ে শরীরে রক্তের পরিমাণ বাড়াতে ডিম খুব উপকারী। ডিমের কুসুমের মধ্যে রয়েছে আয়রন।
তাই রক্তাল্পতার অব্যর্থ ওষুধ ডিম, কিন্তু ভাজা কিংবা পোচ নয়। রোজ একটা করে ডিম সেদ্ধ
খান। মাছ - আয়রনের ভালো উৎস মাছ।
বিশেষ করে কালচে রঙের মাছ। শাল, শোল, ভেটকি, শিং, ট্যাংরা। প্রচুর আয়রন সমৃদ্ধ মাছ
প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় থাকুক। মাংসর মেটে - আয়রন ও ভিটামিন-বি
সমৃদ্ধ মাংসের মেটে উপকারী খাদ্য অ্যানিমিক রোগীদের জন্য। তবে রক্তচাপের রোগীরা এই
মেটে খাবেন কিনা চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করুন।
দুধ - শরীরের প্রয়োজনীয় ভিটামিন
ও প্রোটিন যোগাতে সাহায্য করে। দুধে খুব বেশী আয়রন না থাকলেও সুষম আহারের একটি উপাদান
দুধ যাতে পটাশিয়াম, ক্যালশিয়াম ও সবরকম ভিটামিন উপস্থিত। ফলমূল - সরাসরি আয়রন গ্রহণ
করতে বিভিন্ন ফল খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। প্রতিদিন একটা করে কলা অবশ্যই খাওয়া দরকার,
ছোটো থেকে বড় সকলের। এছাড়া প্রতিদিন আয়রন যুক্ত ফল যেমন --- আপেল, টমেটো, বেদানা, কলা,
আঙুর, কমলা ইত্যাদি দুটো করে ফল খেতে হবে রক্তশূন্যতা থেকে মুক্তি পেতে। প্রতিদিন সকালে কিশমিশ ভেজানো
জল খান, এতে শরীরের দুর্বলতা দূর হবে, রক্ত তৈরি হবে, শরীর চাঙ্গা হবে। এছাড়া কিশমিশ,
কাজু, খেজুর, অ্যাপ্রিক্ট রোজ সকালে একমুঠো করে খান। শরীরে রক্তের পরিমাণ বাড়াতে এই
সব খাবারের জুড়ি মেলা ভার। সাত দিনের মধ্যেই
শরীরে প্রয়োজনীয় রক্ত তৈরি হবে। বিটামিন সি : ভিটামিন-সি শরীরে
আয়রন শোষণের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। তাই রক্তাল্পতা দূর করতে খুবই কার্যকরী উপাদান টমেটো।
টমেটোয় থাকা আয়রন, ভিটামিন-সি, লাইকোপেন রক্তাল্পতা সহ নানা রোগের হাত থেকে আমাদের
রক্ষা করতে সক্ষম। মধু - একটি উচ্চ ঔষধি গুণসম্পন্ন
ভেষজ তরল, যা রক্তাল্পতার সমস্যা দূর করতে অত্যন্ত কার্যকরী। চিনির বদলে নানা খাবারে
মধু যোগ করা যেতে পারে। তাতে চিনির ক্ষতিকর দিক থেকেও বাঁচা যায়। সয়াবিন - উচ্চমাত্রায় আয়রন,
ভিটামিন সমৃদ্ধ সয়াবিন নিয়মিত খেতে পারেন অ্যানিমিক রোগীরা। এর মধ্যে থাকা সাইটিক অ্যাসিড
রক্তাল্পতার সঙ্গে লড়াই। সয়াবিনে রয়েছে কম পরিমাণ চর্বি ও অধিক পরিমাণে প্রোটিন যা
অ্যানিমিয়ার প্রতিরোধী। অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতা
দূর করতে আয়রন সমৃদ্ধ খাবার তালিকা করে খেলেই হবে না তার সাথে জানতে হবে কেমন খাদ্যাভ্যাসের
জন্য আয়রন শোষণ শরীরে কমে যেতে পারে। তার জন্য অ্যানিমিয়ার মাত্রা কমে না। যেমন
--- - খাবার খাওয়ার এক ঘন্টা আগে
পরে চা কফি, কোনো কমল পানীয় খেলে খাবারের আয়রন শরীরে ঠিকভাবে শোষিত হতে পারে না। তাই
সতর্ক থাকুন। - খালিপেটে ফল খাবেন না। ফলের
ভিটামিন সি খাবারের আয়রনকে শোষিত হতে সাহায্য করে। তাই ভরা পেটে ফল খান, হিমোগ্লোবিনের
মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। - খাবার খাওয়ার ঘন্টা দুয়েক
আগে বা পরে ইসবগুল খান। না হলে ফাইবারের ছাঁকনিতে পুষ্টির বেশ কিছুটা আটকে যেতে পারে। - জাঙ্ক ফুট মুখোরোচক খাবার
হলেও কোনো পুষ্টিগুণ নেই। তাই এসবের অভ্যাসে আয়রন শোষণ কমে যায়। - মাছ, মংস, ডিম খাওয়ার পর
দুধের খাবার খাওয়া ঠিক নয়। - রেড মিট, মাছ, বিশেষ করে
কুচো চিংড়ি, ডিম, মেটে ইত্যাদিতে আছে হিম আয়রন। যা সহজে শরীরের কাজে লাগে। আর দুধ,
দুগ্ধজাত খাবার, সবুজ শাক সবজি, মসুর ও অন্যান্য ডাল, বিন পাস্তা, ফল, বাদাম, ফর্টিফায়েড
ব্রেকফাস্ট সিরিয়ালে থাকে নন হিম আয়রন। যা সহজে শোষিত হতে পারে না। দুর্বলতা, মাথা ঘোরা, অল্প
পরিশ্রমে হাঁপিয়ে ওঠা, বুক ধড়ফড়, মাথা ঝিমঝিম, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া --- ইত্যাদি
সমস্যার উদ্ভব হতে থাকলে, চিকিৎসকের পরামর্শ নিন, তার সাথে এইভাবে খাদ্যতালিকা ঠিক
করে দৈনন্দিন জীবনে তা নিয়মিত খেতে থাকুন। শরীর অবশ্যই ভালো হবে। - অতিরিক্ত অ্যানিমিয়ায় চিকিৎসকের
পরামর্শ মতো আয়রন ট্যাবলেট, আয়রন টনিক খাওয়া যায় - সুস্থ হওয়ার জন্য। রক্তাল্পতার বা অ্যানিমিয়ার
সমস্যা কমাতে সেই মানুষটিকেও সতর্ক ও সচেতন হতে হবে। ছোটদের ক্ষেত্রে অভিভাবকগণ সতর্ক
হবেন। বর্তমানে ন্যাশনাল নিউট্রিশনাল অ্যানিমিয়া কন্ট্রোল প্রোগ্রাম বা জাতীয় অপুষ্টিজনিত
রক্তাল্পতা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচীকে আরও ভালোভাবে বাস্তবায়িত করার প্রক্রিয়া চলছে। কারণ,
অপুষ্টিজনিত অসুস্থতা, যে কোনো দেশের উন্নয়নের পথে অবশ্যই বাধা হয়ে থাকে।