Editorial

1 year ago

Exclusion of Darwin’s theory: কেবলই বিবর্তনবাদের বিয়োজন, না কী বর্ণপ্রথাকে প্রশ্রয়!

Darwin’s theory (Symbolic Picture)
Darwin’s theory (Symbolic Picture)

 

শর্মিষ্ঠা দাস , কোলকাতা  : সম্প্রতি এনসিআরটি নবম-দশমের পাঠ্যপুস্তকের সংস্করন ও সরলীকরনের সময় ডারউইনের "জৈবিক বিবর্তনের তত্ত্ব" এর অধ্যায়টি বাদ দিয়েছে , এক্ষেত্রে পাঠ্যক্রম সংস্কারকেরা বলেছেন এই অধ্যায়টি নবম-দশমের জন্য যুক্তিযুক্ত নয়। তবে এই সিদ্ধান্তের পরই বিভিন্ন মহল থেকে না না প্রশ্ন উঠেছে। উল্লেখ্য, এখন দেশের কেন্দ্রীয় বোর্ডের অর্ন্তভূক্ত বহু স্কুলে বর্তমানে ভগবত গীতা কে পাঠ্যক্রমে অর্ন্তভূক্ত করার পাশাপাশি  ডারউইনের "জৈবিক বিবর্তনের তত্ত্ব"-র পাঠটি বাদ দেওয়ার ঘটনাটি নেহাতই কাকতালিও না কী এই বিশেষ প্যাটার্নটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘ ,পরিবার প্রভৃতির ধারণা ছড়িয়ে দেওয়ার একটি পরিকল্পনা তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে। পাঠ্যক্রমের এহেন পরিবর্তন শিক্ষার্থীদের জন্য কতটা প্রাসঙ্গিক তা নিয়ে ও ইতি মধ্যেই বিভিন্ন মহলে বিশ্লেষন শুরু হয়েছে।  

প্রসঙ্গত, পাঁচ বছর আগে, তৎকালীন কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী সত্যপাল সিং দাবি করেছিলেন যে ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব বৈজ্ঞানিকভাবে ভুল এবং স্কুলে পড়ানো উচিত নয়।  তিনি এটিকে অবৈজ্ঞানিক বলে চিহ্নিত করেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর যুক্তি ছিল মানুষ পরম ব্রক্ষ্মের দ্বারা সৃষ্ট এক অসাধারন শক্তির আধার। সেক্ষেত্রে তিনি বিবর্তনের এই যুক্তিটিকে খন্ডন করে এর অযৌক্তিকতার দিকটি সর্বসমক্ষে তুলে ধরেন। তার মতে মানুষ কোনো সামগ্রী নয়, যে তার বিবর্তন সম্পাদিত হবে। সম্ভবত তার যুক্তির জায়গাটি এক্ষেত্রে প্রাধান্য পেয়েছে। মূলত সৃষ্টিবাদে বিশ্বাসীরা মনে করেন যে মানুষ পূর্ব থেকেই মানুষ রুপেই পৃথিবীতে বর্তমান , আজকে আমরা মানুষকে যে ভাবে বিবৃত করি তা কোনো বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে আসেনি। সাথে  তাদের আরো মতামত  ছিল যে ডারউইনের এই তত্ত্ব কখনো কেউ চাক্ষুস করেন নি সেক্ষেত্রে এই তত্ত্বের সত্যতা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে।প্রসঙ্গত, সৃষ্টিবাদে বিশ্বাসীরা মনে করেন, বিশ্বের উৎপত্তির তত্ত্ব  মনে করে যে সমস্ত প্রজাতির প্রাণী এবং উদ্ভিদ আমরা দেখি তা সম্ভবত, একটি ঐশ্বরিক কাজ দ্বারা সৃষ্ট এবং সৃষ্টির পর থেকেই তারা এহেন রূপেই বিদ্যমান,উল্লেখ্য, বাইবেলে ও এই তথ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়, বস্তুত সৃষ্টিবাদ কে সেখানে একটি বৈজ্ঞানিক আধারে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। 

 

গত শতাব্দীতে কিছু সময় পর্যন্ত বিবর্তন বাদ এবং সৃষ্টিবাদকে দুটি পৃথক বিষয় হিসাবে পরিগনিত করা হত। দুটি তত্ত্বকে, বিষয়বস্তুকে একে অপরের পরিপন্থী হিসাবে  অবস্থান করতে দেখা গিয়েছে। প্রসঙ্গত,মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সৃষ্টি বিজ্ঞান এবং বিবর্তন তত্ত্বের সংস্থাপনের ক্ষেত্রে বিস্তর বিতর্ক ও হয়েছে। সৃষ্টি বিজ্ঞানের সমর্থকরা বিদ্যালয়ে বিবর্তন ও সৃষ্টি বিজ্ঞান শেখানোর জন্য সমান অগ্রাধিকার চেয়েছেন।উল্লেখ্য, আরকানসাস রাজ্য এই তত্ত্ব পাঠকে কেন্দ্র করে একটি আইন পাস করেছে, তবে বিবর্তন বাদকে সেখানে অবৈজ্ঞানিক বলা হয়নি, তবে আরকানসাসে সৃষ্টি বিজ্ঞান এবং বিবর্তনবাদের মধ্যে কোন তথ্যটি সঠিক তা বিচার করতে গিয়ে বিচারক  সৃষ্টিতত্ত্ব কে  বৈজ্ঞানিক বলে স্বীকৃতি দিতে অসম্মত হন। 


সৃষ্টিতত্ত্ব ও তার ব্যাখ্যাঃ  

হিন্দু ধর্মতত্ত্ব, পুরাণ ও গীতায় উল্লিখিত পৌরাণিক কাহিনীগুলি মানবসমাজের সৃষ্টিকে একটি ঐশ্বরিক কাজ হিসাবে চিত্রিত করে, যা বিবর্তনবাদকে খন্ডন করে, শুধু তাই নয়  তারা এটাও দাবি করে যে মানবজাতির সৃষ্টির সাথে সাথে, চতুর্গুণ বর্ণপ্রথা এবং ব্রাহ্মণীয় আচার-অনুষ্ঠান গুলিও আদি অনন্তের দ্বারা সৃষ্ট । প্রানের সৃষ্টি করেছেন পরম ব্রক্ষ্ম, তার রূপ, চরিত্র , বর্ণ , কর্ম সকলই পরম ব্রক্ষ্মের দ্বারা নির্দিষ্টকৃত এবং পূর্বনির্ধারিত। 

পাঠক্রমে সৃষ্টি বিজ্ঞান এবং বিবর্তন তত্ত্বের সংযোজন ও বিয়োজনঃ 

সম্প্রতি বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে গীতা প্রবর্তনের জন্য ভারতের বিজেপি সরকারের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ এবং পাঠ্যপুস্তক থেকে ডারউইনের বিবর্তনীয় তত্ত্ব মুছে ফেলা  নিয়ে বিস্তর বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এই ঘটনা পুনরায় সৃষ্টি বিজ্ঞান এবং বিবর্তন তত্ত্বের যে সংঘাত কে প্রকাশ্যে এনেছে। এর ফলে আবার এই দুই তত্ত্বের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ও অবৈজ্ঞানিক কাঠামো নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত করেছে। 

গীতা মূলত কর্ম যোগের কথা বলে। হিন্দুদের এই ধর্মগ্রন্থ ১৮টি অধ্যায়ে বিভক্ত যার মধ্যে ৭০০  টি শ্লোক রয়েছে। এতে কর্ম যোগের পাশাপাশি নিঃস্বার্থ কর্ম সম্পাদনের কথা বলে। এর পাশাপাশি বৈদিক কর্ম , যজ্ঞের না না বিধ আচার বিধি চার প্রকার বর্ণের প্রকারভেদ এই সবই পরম ব্রক্ষ্মের দ্বারা সৃষ্ট বলে উল্লেখ করা আছে। 


(এটি অধ্যায় ৪, ১৩তম শ্লোকে হাইলাইট করা হয়েছে, যেখানে প্রভু ঘোষণা করেছেন:

চতুর-বর্ন্যম-মায়াশ্রীষষ্ঠম গুণ-কর্ম-বিভাগশঃ

তস্য কর্তারম অপি মাম বিদ্যাকর্তাম অব্যয়ম

এর অর্থ হল- "চতুর্গুণ বর্ণ আমার দ্বারা মানুষের গুণ ও কর্ম অনুসারে সৃষ্টি হয়েছিল। যদিও আমি এই ব্যবস্থার স্রষ্টা, তবুও আমাকে অকার্য ও পরিবর্তনহীন বলুন।") 

সামাজিক সংস্কারক এবং ভারতীয় সংবিধানের প্রতিষ্ঠাতা বি. আর. আম্বেদকারের লেখা এবং বক্তৃতার ভলিউম ৩  (মহারাষ্ট্র সরকার কর্তৃক প্রকাশিত ) অনুযায়ী গীতার পাঠ পশ্চাদগামী এবং মানব সভ্যতার পরিপন্থী। পূর্বে উল্লিখিত উদ্ধৃত শ্লোকটির উল্লেখ করে বর্ণপ্রথা সমাজের পক্ষে কতটা অপ্রয়োজনীয় এবং এই প্রথা কিভাবে সমাজের অগ্রগতির পথে বাধার সৃষ্টি করছে তা ব্যাখ্যা করেছেন। 

বস্তুত গীতা সৃষ্টির ধারনাকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে জাতপাতের মত সংকীর্ণতার প্রসঙ্গটিকে মান্যতা প্রদান করার পাশাপাশি না না বিধ ঐশ্বরিক আচার-অনুষ্ঠানকে ও প্রাধান্য দিয়ে থাকে। স্কুল পাঠ্যে যদি গীতার কর্ম যোগের দিকটিকে প্রাধান্য দিয়ে পড়ানো হয় সেক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থীর জীবনকে অনেক বেশী বাস্তবমুখী করে তোলা সম্ভব হবে, কিন্তু অপর পক্ষে যদি গীতার সৃষ্টিতত্ত্বের দিকটি সম্পর্কে যত্নশীল ভাবে শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয় সেক্ষেত্রে ধর্মের গোঁড়ামী তথা সামাজিক বৈশম্যের দিকটি অধিক প্রকটিত হতে পারে, প্রসঙ্গত, গীতায় না না বিধ পৌরানিক কাহিনী ঈশ্বরবাদ,বর্ণবিভেদ, সামাজিক না না বিধি সম্পর্কে তথ্য প্রদান করে থাকে, যা  ক্ষেত্রবিশেষে সামাজিক কাঠামো তথা ভারতীয় সংবিধানের পক্ষে  কিঞ্চিত বিপদের সংকেত হতে পারে। 

প্রসঙ্গত ভারত একটি সর্বধর্ম সহিষ্ণু দেশ হবার পাশাপাশি আমাদের সংবিধান সকল ধর্মের প্রতি সম্ভ্রম ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের কথা বলে, সেক্ষেত্রে শিক্ষা ক্ষেত্রে যদি কেবল বিশেষ কোনো ধর্মের পুস্তক পড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তা সমাজের যারা ভবিষ্যত অর্থাৎ ছাত্রদের মধ্যে ধর্মীয় সংকীর্ণতা তৈরী করতে পারে, যা কেবল অপর ধর্মের মানুষের জন্যই নয় এমন কী নিজের ধর্মের মানুষের মধ্যে ও বিভেদ আনবে যা সমাজের কাঠামো কে দুর্বল করে দিতে পারে।   

এর পরিপ্রেক্ষিতে এমন বিতর্ক আসতে পারে যে, আমাদের দেশের মাদ্রাসা গুলিতে ইসলামিক ধর্মগ্রন্থকে পঠন পাঠন হয়ে থাকে। তা হলে সেক্ষেত্রে হিন্দু ধর্মগ্রন্থ পঠন পাঠনে কেন এত বিতর্ক, সেক্ষেত্রে বলা যেতে পারে ভারতে এখনো টোল-এ পঠন পাঠন হয়ে থাকে, সেখানে শুদ্ধ সংস্কৃতে পাঠ দানের পাশাপাশি না না বিধ আচার অনুষ্ঠান সম্পাদনের বেদ মন্ত্রের ও পাঠ দেওয়া হয়।  অর্থাৎ কোনো বিশেষ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় গ্রন্থের পঠন পাঠন করা যেতেই পারে সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থী  ও তার অভিভাবক সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়েই এই পঠন পাঠনে যোগ দেবে। 

অপর পক্ষে কোনো সাধারন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেখানে সকল ধর্ম ও বর্ণের শিক্ষার্থী একত্রে পাঠ নিয়ে থাকে সেই  সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশেষ কোনো ধর্মগ্রন্থ পাঠের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা আসতে পারে।উল্লেখ্য, বিদ্যালয় পাঠক্রমে গীতা পঠিত হলে অহিন্দু শিক্ষার্থীর সেই পাঠ মনোগ্রাহী না হতে পারে সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থীটির স্কুলছুট হবার একটি প্রছন্ন সম্ভাবনা তৈরী হতে পারে। আবার গীতায় উল্লিখিত বর্ণপ্রথার অধ্যায়টি কোনো শিক্ষার্থীর বংশপরিচয় বা তার সামাজিক অবস্থানের দিকটি কে প্রকটিত করতে পারে সেক্ষেত্রে জাতপাতের বিভেদ যা হয়ত শিক্ষার্থীর অজানা ছিল তা তার কাছে উন্মোচিত হলে তার মনোস্তাত্তিক পরিবর্তন আসতে পারে। উচ্চ বংশীয় হলে তেমন সমস্যা না ও হতে পারে কিন্তু নিম্ন বর্ণীয় হলে শিক্ষার্থীটি হীনমন্যতায় ভুগতে পারে, বা তাকে হয়ত শিক্ষাক্ষেত্রে এমন অপ্রিতিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হতে পারে যা শিশু মনকে আঘাত করতে পারে, হয়ত শিশুটি নিরাপত্তার অভাবে ভুগতে পারে সেক্ষেত্রে শিশুটির মানসিক বিকাশ ব্যহত হতে পারে। 


সেক্ষেত্রে মূলস্রোতের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বদলে বিশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় শিক্ষা দানের ব্যবস্থা করা হলে সামাজিক কাঠামোকে অক্ষুন্ন রেখে সামাজিক অগ্রগতিকে গতিদান করা অনেক বেশি সহজ ও সম্ভবপর করে তোলা সম্ভব হতে পারে। এর পাশাপাশি বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমানিত বিষয়গুলিকে পাঠক্রমে আরো অধিক ভাবে সংযোজন করা আবশ্যক , এর দ্বারা শিক্ষার্থীর মনে নতুন তথ্যকে জানার আগ্রহ তৈরী করবে যা শিক্ষার্থীর মানসিক বিকাশকে প্রভাবিত করবে এবং তার বিকাশে সহায়তা করবে। 

বস্তুত পক্ষে পাঠ্যক্রম এমন হবে যা শিক্ষার্থীর সর্বাঙ্গীন বিকাশকে প্রভাবিত করবে।অর্থাৎ তার বৃদ্ধি ও বিকাশে সহায়তা করতে পারে যে বিষয় গুলি তা অধিক মাত্রায় সংযোজিত করতে হবে। পাঠ্যক্রম যাতে শিশু মনের সকল প্রশ্নের সমাধান করতে পারে সে বিষয়টি কে প্রাধান্য দিতে হবে। মূলত পাঠক্রমে নিজের ঐতিহ্য,সংস্কৃতি, ধর্মের পাশাপাশি বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত শিক্ষা কে ও সংযোজিত করতে হবে যা একটি শিশুর সর্বাঙ্গীন বিকাশকে সম্পূর্ণতা প্রদান করবে। 

You might also like!