Editorial

1 year ago

Matri Bhasha Dibash : ফেব্রুয়ারী ও মাতৃভাষা বাংলা -ড : সূর্য শেখর পাঠক

Matri Bhasha Dibash
Matri Bhasha Dibash

 

                                                                               ' আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারী।

                                                                                                          আমি কি ভুলিতে পারি।'

 আবদুল গাফারের এই গানটি সত্যিই চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। একুশে ফেব্রুয়ারী দিনটি কোনো বাংলা ভাষী মানুষেরই ভুলে যাওয়ার কথা নয় । এই দিনটিতেই মাতৃভাষা বাংলার সম্মান রক্ষার্থে বিশ্ব ইতিহাসে এক নজীর বিহীন ঘটনা ঘটিয়ে ছিলেন কয়েকজন বাংলাভাষী সোনার ছেলে । তাঁরা দেখিয়ে গিয়েছেন মায়ের মুখের ভাষা শুধু মাত্র ভাষা নয় , তা মায়ের ই তুল্য। ভাষার জন্যে শহীদ হওয়ার এই ঘটনা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে রয়েছে।

 ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী অধুনা বাংলা দেশের ঢাকা শহরে ভাষা আন্দোলনকারীরা ' জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য চিত্ত ভাবনা হীন ' এই মন্ত্র নিয়ে পঙ্গ পালের মতো বেরিয়ে পড়েছিলেন রাজপথে । তৎকালীন সরকারের বর্বর পুলিশ বাহিনী বিপুল সংখ্যক আন্দোলনকারী  জনতাকে দেখে কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে কোনো প্রকার সতর্কতা না জানিয়েই অন্ধের মতো গুলি চালাতে শুরু করে দিয়েছিলো দুর্বৃত্তের দল। রাজপথে রক্ত রঞ্জিত হয়ে লুটিয়ে পড়েছিলেন মহম্মদ শালাউদ্দীন, আবুল বরকত, রফিকুল ইসলাম, জব্বার, সালাম আরও অনেকে । সেদিন ঢাকার রাজপথে বাস্তবায়িত হয়েছিল কোন এক নাম না জানা বাউলের ভাষা আন্দোলন বিষয়ক সেই গান ------

                                                                                                                        ' অন্য কথা কইমুনা

                                                                                                            যায় যদি ভাই, দিমু সাধের জান

                                                                                                               সেই জানের বদলে রাখমুরে 

                                                                                                                     বাপ দাদার জবানের মান

                                                                                            আমার মায়ের মত গান, আমার মায়ের মত প্রাণ। '

 সেদিনকার শহীদের রক্ত ব্যর্থ  যায়নি । তৎকালীন পাকিস্তান সরকারকে ভাষা আন্দোলনকারীদের কাছে নতি স্বীকার করতে হয়েছিল । এবং আজ ওই দিনটিকে কেন্দ্রকরেই আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক ক্যালেন্ডারে বাংলা ভাষা আন্দোলন বিশ্ব মর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে । বিশ্ব ভাষা প্রেমিক সমিতি থেকে রফিকুল ইসলাম ১৯৯৮ সালের ৯ ই জানুয়ারী রাষ্ট্র সংঘের সাধারন সম্পাদক কফি আননকে ২১ শে ফেব্রুয়ারী দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস রূপে গণ্য করবার যে আবেদন করেছিলেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহযোগিতায় তা ১২ ই নভেম্বর ২০০০ সালে মঞ্জরী লাভ করে।

 ২১ শে ফেব্রুয়ারী ছাড়াও বাংলা ভাষা আন্দোলন এর ইতিহাস এ ১ লা নভেম্বর ১৯৫৬ ও ১৯ শে মে ১৯৬১ এই তারিখ দুটিও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

থাক সে অতীতের কথা। বর্তমানের কথায় আসা যাক। এক সময় মাতৃ ভাষা বাংলার জন্য অনেকেই আম্ব বলি দিয়েছেন - ইতিহাস তার সাক্ষী । কিন্তু প্রশ্ন হল আজকে আমরা নিজের মাতৃভাষার জন্য কী করছি ! আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে যে শিক্ষা দিচ্ছি তাতে কি বাংলা ভাষার গৌরব বৃদ্ধি পাচ্ছে ! আজকের বিশ্বায়নের যুগে ইংরেজী ভাষার শিক্ষা লাভ যথেষ্ট প্রয়োজন তাতে কোন দ্বিমত নেই কিন্তু আমরা তো ইংরেজী শিখবার জন্য আমাদের ছেলে মেয়েদের উৎসাহ দিচ্ছি না । আমরা তো তাদের ইংরেজির দাসত্ব করবার কুশিক্ষা দিয়ে চলেছি । মনে পড়ে যায় বঙ্কিম চন্দ্র - এর বাবু সমাজ সম্পর্কে অভিমত। তিনি বলেছেন, ' যাহারা বাক্যে অজেয় পর ভাষা পারদর্শী মাতৃভাষা বিরোধী তাহারাই বাবু।'  

 আজকে আমরা ' জন্মদিন ' বিবাহবার্ষিকী ' ' ধন্যবাদ ' ' স্বাগতম ' ইত্যাদি অসংখ্য সুমধুর বাংলা শব্দ মুখে আনতে দ্বিধাবোধ করি । শুধু তাই নয় ' মা ' ' বাবা ' ' দাদু ' ' দিদিমা ' ডাক শুনতে ও লজ্জা বোধ করি। ' আমার ছেলে মেয়েরা বাংলা লিখতে পড়তে জানেনা ' - এই কথাটি বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয় পরিজন কে বলবার সময় আমাদের বুক গর্বে ফুলে ওঠে । বঙ্কিমচন্দ্র বাঙালিকে কশাঘাত করবার জন্য যথার্থই বলেছিলেন , ' হে ইংরেজ আমি তোমায় প্রণাম করি । আমি মাতৃভাষা ত্যাগ করিয়া তোমার ভাষা কহিব, তোমার পিছু পিছু বেড়াইব ।' 

অধ্যাপক সাইদুর রহমান খান ভাষার অস্তিত্ব সম্পর্কে গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছেন যে, ইংরেজী, ফরাসি ও জার্মান ভাষা হচ্ছে খুনী ভাষা । এদের প্রভাবে অনেক ভাষায় লোপ পেয়ে যাচ্ছে। ভাষাবিদ ডেভিড ক্রিস্টাল দীর্ঘকাল ভাষা সম্পর্কে গবেষণা করে দেখেছেন যে পৃথিবীতে প্রতি বৎসর প্রায় চব্বিশটি করে ভাষা লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

 আমরা বাংলা ভাষাভাষী সন্তানেরা মুখবুজে নিজের মাতৃভাষার অব লুপ্তির পথে এগিয়ে যাওয়াই কেবলমাত্র দেখছিনা বরং সে পথকে প্রশস্ত করে চলেছি।

 বঙ্গ ভাষীরা কেন বিদেশী ভাষার দাসত্ব করবার জন্য বাধ্য হচ্ছে এই কারণটি ই সুস্পষ্ট নয় । কী নেই বাংলা ভাষার মধ্যে ! যে ভাষার কবি সাহিত্য নোবেল বিজয়ী সে ভাষার সমৃদ্ধি, আভিজাত্য এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠা বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ থাকতে পারে না।

 সম্পুর্ণ বিশ্বে বহু ভাষা প্রচলিত থাকলেও নব্বই শতাংশ মানুষের মুখের ভাষা মাত্র একশোটি । এর মধ্যেও আবার মাত্র যে আটটি ভাষায় পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানুষ কথা বলে সেই আটটি ভাষা চীনা, ইংরেজী , হিন্দি , স্প্যানিশ , রুশ , আরবি, পর্তু গীজের সঙ্গে বাংলা ভাষাটিও রয়েছে । বিশ্বের শীর্ষ ভাষার তালিকার মধ্যে বাংলার স্থান চতুর্থ।

ভারতের মতো বিশাল দেশে বাংলা ভাষার গুরুত্ব কতখানি তা  একটি মাত্র উদাহরণ তুলে ধরলেই বিষয়টি বোধগম্য হয়ে যাবে । ১৯৬১ সালের জনগণনা অনুযায়ী ভারতে মোট ১৬৫২ টি মাতৃভাষা প্রচলিত রয়েছে । অথচ এমন একটি বহুভাষী দেশের রাষ্ট্রীয় সংগীত বাংলা ভাষায় রচিত । শুধুমাত্র তাই নয়, প্রতিবেশী অবাঙ্গলাভাষী রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রগীতেও বাঙালী কবির ভূমিকা উল্লেখ যোগ্য । ভাষার নামে রাষ্ট্র গঠন কেবল মাত্র বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেই সম্ভব হয়েছে । সুতরাং একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, স্বদেশ এবং সম্পূর্ণ বিশ্বের ইতিহাসে বাঙলা ভাষার দান এবং স্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

শিক্ষাক্ষেত্রে মাতৃ ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান শ্রেয়, এই কথাটি বহু প্রখ্যাত ব্যাক্তির অভিমত থেকেই জানতে পারা যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৮৩ সাল থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত মাতৃভাষা কে শিখার বাহন হিসেবে গ্রহণ  করবার স্বপক্ষে অক্লান্ত ভাবে প্রচার করেছিলেন । তিনি বলেছেন, '  মাতৃভাষা ই মাতৃদুগ্ধ। ' রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন ছাত্রদের ওপর ইংরেজী ভাষার বোঝা তাদের প্রতিভার বিকাশে প্রতিবন্ধক । স্বামী বিবেকানন্দ বাংলা ভাষার মাধ্যমে  বিজ্ঞান শিক্ষার ওপর বিশেষ জোর দিয়েছিলেন । গান্ধীজী মাতৃভাষায় শিক্ষার প্রবল সমর্থক ছিলেন । ১৯৬১ সালে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জহরলাল নেহরু মুখ্যমন্ত্রী সম্মেলনে যে ত্রিভাষা সূত্র দিয়েছিলেন , তার মূল ছিল মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা।

 ' এ ' ফর অ্যাপেল এ আজকের শিশু যতই সুপুষ্ট হচ্ছে ' অ ' - এ অজগর ততই অপুষ্টিতে ভুগছে। এরজন্য দায়ী অভিভাবকগণ এবং প্রতিটি বাঙলাভাষী মানুষ। আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলি তাতে কোন ক্ষতি নেয়। ক্ষতি হচ্ছে বাঙলা বর্জিত শিক্ষা প্রদান।  কেননা, মাতৃ ভাষায় অজ্ঞ থেকে কখনোই প্রকৃত জ্ঞান অর্জন সম্ভব নয়। 

 পথভ্রষ্ট মধুসূদন সময় থাকতেই ফিরে এসেছিলেন বঙ্গ সাহিত্য দেবীর চরণ তলে। আজ যারা দিক ভ্রান্ত হয়ে ছুটে চলেছেন তারা কতদিন এ সঠিক পথের সন্ধান খুঁজে পাবেন কে জানে ! 

দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের প্রতি আমাদের প্রথম এবং প্রধান কর্তব্য হচ্ছে তাদের মন থেকে মাতৃভাষা সম্পর্কে অবজ্ঞা দূর করে বাংলা ভাষার প্রতি আগ্রহ জাগিয়ে তোলা । মাতৃভাষা বাংলার আভিজাত্য, মধুরতা , প্রয়োজনীয়তা, গুরুত্ব সম্পর্কে আমাদের ছেলেমেয়েদের সঠিক ভাবে বুঝিয়ে দিতে পারলেই তারাও কবির কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে গেয়ে উঠবে -

                                                                                                   ' মোদের গরব মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা।

                                                                                             তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালোবাসা ।'

                                                                                                      কি যাদু বাংলা গানে, গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে,

                                                                                                  গেয়ে গান নাচে বাউল, গান গেয়ে ধান কাটে চাষা । ........

You might also like!