দুরন্ত বার্তা ডিজিটাল ডেস্কঃ রিয়াং নদীর নাম প্রথম পড়েছি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘তখনও রিয়াংখোলা থেকে’ কবিতায়। যেন হাত ধরে উপলাকীর্ণ স্রোতধারার ধারে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়। যোগীঘাটের নাম কিন্তু আগে শোনা ছিল না! প্রথম এসে নিজের চোখে রিয়াংয়ের ব্যতিক্রমী চলন ও দু’পারের চোখজুড়নো প্রকৃতি দেখে প্রেমে পড়ে গেলাম। শীতের শেষে ধাপে ধাপে রিয়াংয়ের বেডে নেমে যাওয়া নিসর্গের বিস্তৃত ক্যানভাসে রং কিছু কম পড়েনি। সকাল থেকে বিকেল সেই রঙের অদলবদল যোগীঘাটের প্রকৃতিকে আরও বৈচিত্রময় ও উপভোগ্য করে তোলে। এই সব নিয়ে কয়েক দিন সত্যিই যেন অজ্ঞাতবাসে কেটে যায় অবলীলায়।
বছরের যে কোনও সময়ে ছোট ছুটি সম্বল করে রিয়াং নদীর গান শোনার জন্য যাওয়া যেতে পারে যোগীঘাট। উচ্চতা সাড়ে তিন হাজার ফুটের কাছাকাছি হওয়ায় শীত-গ্রীষ্ম, কোনওটারই তীব্রতা সে রকম পীড়াদায়ক নয়। সেরা মানের কমলালেবুর জন্য বিখ্যাত সিটংয়ের নিম্নবর্তী অংশে সব দিক থেকে (সিটং-২ খাসমহল) ব্যতিক্রমী প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার যোগীঘাট। এটি মূলত একটি সঙ্কীর্ণ উপত্যকা। কার্শিয়াংয়ের পাহাড় ও মংপুর পাহাড়কে যুক্ত করেছে নদীর ওপরে নবনির্মিত একটি সেতু। সিটংয়ের দিকের পাহাড়ে মনোরম ধাপচাষের জমি, আর একটু ওপর দিকে কমলালেবু ও ফুলের বাগান। আবার লাবদা হয়ে মংপুর পাহাড়ে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে সিঙ্কোনা গাছের চাষ ব্রিটিশ আমল থেকে আরম্ভ হয়েছে।
পথের পাশে জঙ্গলের শোভাও এককথায় অসাধারণ। আলো-ছায়ার আল্পনা আঁকা পার্বত্যভূমি। মধ্যিখানে যোগীঘাট অনেকটা নীচে, নদীর সমতলে। ধনুকের মতো বেঁকে যাওয়া রাস্তার দু’পাশে দুই মানুষ সমান ঝাড়ু ও শরগাছের বন। বর্ষায় ঘন সবুজ, শীতে সোনা হলুদ রঙের বন্যা। তার এক ধাপ নীচ দিয়ে পাথরে পাথরে ধাক্কা খেয়ে খরস্রোতে বয়ে গিয়েছে অপরূপা রিয়াং নদী। কোথাও কোথাও পাথরে বাধা পেয়ে ঝর্নার রূপ নিয়েছে। কোথাও আবার বোল্ডারের প্রাচীর দিয়ে ঘেরা প্রাকৃতিক সুইমিং পুল। স্নান করার মজাই আলাদা।এখানে বসতি বলতে কয়েকটি বাড়ি ও দোকান সেতুর পাশে। তার মধ্যে একটি হোমস্টে। একটু দূরে চলে গেলে নিরালা নিসর্গের রাজপাট জমজমাট। ধাপে ধাপে চাষের জমি। কয়েকটা কাঠের বাড়ি, নানা রঙে রাঙানো। পাশ দিয়ে সর্পিল রাস্তা ওপরে উঠে গিয়েছে। এই পথে গাড়ি নিয়ে নানা আকর্ষণের কেন্দ্র তুরুক খাসমহল ঘুরে আসা যাবে। অনেক কাল আগে ইংরেজ আমলে তুরুক খাসমহল ছিল আরণ্যক এলাকা। এখন হাজার পাঁচেক ফুট পাহাড়ের ওপরে বিরাট বর্ধিষ্ণু গ্রাম। নানা রকম চাষের আয়োজন, জৈবসার ব্যবহার করে।
তুরুকের পাশের গ্রাম মামরিং লেপচা উপজাতি অধ্যুষিত। ফুলবাগানের একধারে কাঠের তৈরি তাদের ট্র্যাডিশনাল বাড়ি সাজিয়ে রাখা হয়েছে পর্যটকদের দেখার জন্য। তুরুক গ্রামের অন্য প্রান্তে চোর্তেন ও মনাস্ট্রিও পারিবারিক সম্পত্তি। কিন্তু প্রবেশ অবাধ। যেমন আকর্ষক বাইরের অংশ, তেমনই নজর কাড়ে ভেতরের মূর্তিকলা ও রঙিন শিল্পকর্ম। গাড়িতে আর সামান্য গেলেই মহলদিরামে মনোরম চায়ের দেশ ও কাঞ্চনজঙ্ঘা ভিউপয়েন্ট। ফটোগ্রাফারদের প্রিয় স্থান। লুপ্তপ্রায় প্রাণী হিমালয়ান নেউট বা স্যালামান্ডারের বাসভূমি নামথিং পোখরি এখান থেকে বেশি দূরে নয়। বস্তুত, কমলার দেশ সিটং ও সিঙ্কোনার দেশ লাটপাঞ্চারের সব দর্শনীয় স্থান একই দিনে গাড়িতে ঘোরা সম্ভব যোগীঘাটকে কেন্দ্র করে। বাগোড়া, চিমনি হয়ে ওল্ড মিলিটারি রোডের অনবদ্য বন্য সৌন্দর্যের ভেতর দিয়ে কার্শিয়ং ঘুরে আসতে পারবেন কয়েক ঘণ্টায়। অন্য দিকে, মংপুতে রবীন্দ্রতীর্থ যাওয়া বা আসার পথে ঘোরা হয়ে যাবে। তার মানে, যোগীঘাট নামটা আনকোরা হলেও জায়গাটি উত্তরবঙ্গের চেনা মানচিত্রের বাইরে নয়।
গাছ,পাহাড়,নদী,ঝর্ণা মিশিয়ে এক অনিন্দ্য সুন্দর জায়গা। রিয়াং নদীর পাশেই অবস্থিত এই স্থান। যোগীঘাটে গেলে, আপনর মন যে হারাবেই সে কথা বলাই বাহুল্য। পাহাড়, বন-জঙ্গলের মধ্যে সে এক অনন্য স্থান! বসন্তের মরশুমে গাছেরা তাদের পাতা ঝরিয়ে সেখানে এনেছে নতুন কচি পাতা। তার মাঝে প্রেয়সীর সাথে অফুরন্ত সময়। সাড়ে তিন হাজার ফুট উঁচুতে এই জায়গায় ঘোরার মত অনেক জায়গাই রয়েছে। আর এই উচ্চতার জন্য শীত অথবা গরম পুরো সময়টাই বেশ উপভোগ্য। এখানে জানিয়ে রাখি যোগীঘাটে কিন্তু সেরা মানের কমলালেবু পাওয়া যায়। এখান থেকে সামনেই স্যালামান্ডারের বাসভূমি নামথিং পোখরি থেকেও ঘুরে আসতে পারেন। কার্শিয়াং-ও খুব একটা দূর নয় যদিও। মংপুতে রবীন্দ্রতীর্থ দেখে আসতে পারবেন। তাই আর দেরি নয়,ব্যাগ গুছিয়ে চলুন যোগীঘাট।
যাওয়া - নিউ জলপাইগুড়ি বা শিলিগুড়ি থেকে যেতে পারবেন। সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে দু’টি রাস্তা হয়ে যাওয়া যায় যোগীঘাট। এরমধ্যে একটি হলো রোহিনী রোড, কার্শিয়াং, দিলারাম হয়ে। অন্যটি সেবক রোড, রম্ভি, মংপু, লাবদা হয়ে। দুই রাস্তাতেই শিলিগুড়ি থেকে ৭০-৭৫ কিমি দূরে এইস্থান।
থাকা - প্রসঙ্গত, এখানে থাকার জন্য পেয়ে যাবেন হোম স্টে। থাকা খাওয়া মিলিয়ে জনপ্রতি ১২০০ থেকে ১৫০০ এর মতো খরচ হবে আপনার। অ্যাডভেঞ্চার প্রেমীরা রিয়াং নদীর পাশে তাঁবু খাঁটিয়ে থাকতে পারে।