Entertainment

19 hours ago

Meena Kumari tragic life:বিয়ের বন্ধন ভেঙে বেরিয়ে এলেন, কিসের খোঁজে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলেন মীনা কুমারী?

Meena Kumari tragic life
Meena Kumari tragic life

 

দুরন্তবার্তা ডিজিটাল ডেস্ক :  জীবিতকালেই তাঁর নামের আগে জুড়ে গিয়েছিল এক অনন্য অভিধা—ভারতীয় রূপোলি পর্দার 'ট্র্যাজেডি কুইন'। দর্শকের চোখের জলে সাড়া ফেলে দেওয়া সেই মুখ, যে পর্দায় কাঁদলে গোটা দেশ যেন নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলত। কিন্তু এই 'ট্র্যাজেডি কুইন' তকমাটি অনেক সময়েই যেন তাঁর শিল্পীসত্তাকে একরৈখিক করে তোলে—যেন মীনা কুমারী শুধু বিষাদ আর বেদনার প্রতিমূর্তি।

কিন্তু, যদি ফিরে দেখা যায় তাঁর কাজ আর সেই কাজের ছায়ায় ছায়ায় ঘুরে বেড়ানো ব্যক্তিগত জীবন—তাহলে বোঝা যায়, এই ‘ট্র্যাজিক’ অভিধার গভীরতাই ছিল আলাদা। খ্যাতির আলোয় ভেসে চলার পাশাপাশি তাঁর সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে ছিল শৈশবের দারিদ্র্য, বিবাহিত জীবনের ভাঙন, অসম্পূর্ণ প্রেম, এবং চেনা মানুষের বিশ্বাসঘাতকতা।  ‘জিন্দগী ইয়ে হ্যয়’ কবিতায় মীনা লিখছেন,

‘দর্দ কে সায়ে, উদাসী কা ধুঁয়া, দুখ কি ঘটা

জিন্দগী ইয়ে হ্যয় তো ফির মওত কিসে কহতে হ্যয়’

(বেদনার ছায়া, ধোঁয়ার মতো ঘিরে থাকা বিষণ্ণতা, দুঃখের মেঘ, এ-যদি জীবন হয়, তাহলে কাকে বলে মৃত্যু!)।

আবার, অন্য দিকে মনে হয়, যে বিমর্ষ বিষাদ অন্তহীন সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনায় তিনি ফুটিয়ে তুলতেন তাঁর সাবলীল অভিনয়ের মাধ্যমে একের পর এক চরিত্রে, তাঁর নিজের মনকেও কি তিনি সেই বিষাদের হিমশীতল আলো-আঁধারিতেই নিমজ্জিত রেখেছিলেন আজীবন? হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে চাওয়াটাই কি ছিল তাঁর শিল্পীসত্তার স্বাভাবিক প্রকাশ? নাকি, জাত শিল্পীদের ধরনে ব্যক্তিজীবনের ঘটনাপ্রবাহের উত্তপ্ত খাদহীন অভিঘাতই হয়ে উঠত তাঁর শিল্পের উপাদান?

নায়িকা এবং অভিনেত্রী হিসাবে খ্যাতির সাফল্য-শীর্ষে পৌঁছোনোর পরেও মীনা কুমারীর জীবন ছিল, জীবনানন্দ দাশের ভাষা ধার করে বলতে হয়, ‘বিমর্ষ পাখির রঙে ভরা’। অন্য অভিনেত্রীদের সঙ্গে মীনা কুমারীর প্রধান পার্থক্য— যে পার্থক্য একান্ত ভাবে বোধহয় তাঁরই বৈশিষ্ট্য সেটা হল, তাঁর শ্রেষ্ঠ কাজগুলি কোনও না কোনও ভাবে সরাসরি, প্রায় সরল রেখার মতো তাঁর যাপিত অস্তিত্বকেই স্পর্শ করে গিয়েছে। মীনা কুমারী পরিচালক ছিলেন না। তিনি অন্যের ছবিতে অভিনয় করতেন। সে-দিক দিয়ে দেখলে চরিত্র আর জীবনের এই মিলগুলো কি আকস্মিক, নিছক সমাপতন? ‘ছোটি বহু’ (সাহিব, বিবি অউর গুলাম), ‘সাহিবজান’ (পাকিজ়া), ‘করুণা’র (দিল আপনা অউর প্রীত পরাই) মতো চরিত্রে সরাসরি মীনা কুমারীরই জীবনের টুকরো খুঁজে পাই যেন। জীবনের অন্তিম পর্বে, যখন মাত্রাতিরিক্ত সুরার বিষ তাঁকে ঠেলে দিচ্ছে আত্মধ্বংসের পথে, সে প্রসঙ্গে ‘সাহিব, বিবি অউর গুলাম’-এর পরিচালক আব্রার আলভির স্মৃতিচারণ: ‘সে বড় ট্র্যাজিক দৃশ্য ছিল আমার কাছে। মদের নেশায় (মীনা) নিজেকে যে-ভাবে ডোবাতে শুরু করেছিল, তাতে মনে হচ্ছিল ছোটি বহু-র গল্পটিই বাস্তব পরিণতি পাচ্ছে’।

এখানে আর একটা কথা বলা দরকার, ছবি এবং ব্যক্তিজীবনে যে মীনা কুমারীকে আমরা দেখি, তারই পরিপূরক তাঁর কাব্যগুচ্ছ। ১৯৬৪ সালে নিজের লেখা কয়েকটি গজ়ল, শের ও নজ়ম নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল মীনা কুমারী ‘নাজ়’-এর এলপি অ্যালবাম, ‘আই রাইট, আই রিসাইট’। উর্দু কবিদের রীতিমাফিক মীনা কুমারীও কবিতা লেখার জন্য একটি ‘তখল্লুস’ (ছদ্মনাম বা উপাধি) বেছে নিয়েছিলেন, সেটা হল ‘নাজ়’ (গর্ব, অহংকার)। ১৯৭২ সালে মীনার মৃত্যুর পর পরই তাঁর শায়রী ‘তনহা চাঁদ’ শিরোনামে প্রকাশিত হয় তাঁর ঘনিষ্ঠ গীতিকার গুলজ়ারের সম্পাদনায়। মৃত্যুর আগে অভিনেত্রী নিজের যাবতীয় ডায়েরি ও কবিতার খাতা তাঁকেই দিয়ে গিয়েছিলেন।

মীনা কুমারী তাঁর পেশাকে স্বেচ্ছায় নির্বাচন করেননি, কোনও আকস্মিক সুযোগ ঘটিয়ে সিনেমা-জগৎ তার দরজা তাঁর সামনে খুলে দেয়নি। সে-সবের প্রয়োজনও ছিল না। যাঁর প্রায় চল্লিশ বছরের আয়ুষ্কালের চৌত্রিশ বছরই কেটেছে ক্যামেরার সামনে, তাঁর সম্পর্কে বলা চলে, এটা ছিল তাঁর অমোঘ ভবিতব্য। ছ’বছরের মাহজ়বিন বানো (মীনা কুমারীর প্রকৃত নাম) যেদিন ২৫ টাকা বেতনে বিজয় ভট্টের ছবি ‘লেদার ফেস’-এ (১৯৩৯) শিশুশিল্পী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন, সেদিন কি তিনি ঘুণাক্ষরেও বুঝেছিলেন এই কাজটাই তাঁকে আমৃত্যু করে যেতে হবে?

একবার রেডিয়ো সাক্ষাৎকারে আমিন সায়ানি তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘অল্পবয়সে যখন সকলেই স্কুলে যায়, আপনি বেছে নিয়েছিলেন স্টুডিয়োকে। কেন?’ অভিমান আর অভিযোগ মেশানো ছোট্ট হাসি হেসে মীনা উত্তর দেন, ‘আমি বেছে নিইনি। নিয়তিই টেনে এনেছে। চেয়েছিলাম স্কুলে যাব, লেখাপড়া শিখে ডাক্তার, উকিল কিছু একটা হব। আমার নিয়তিই আমায় সিনেমা অভিনেত্রী বানিয়েছে।’

স্কুলে পাঠানোর পরিবর্তে শিশুকন্যাকে সিনেমায় নামানোর সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন মীনার পিতা, পার্সি থিয়েটারের হারমোনিয়ম-বাদক ‘মাস্টার’ জনাব আলি বকশ। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল খুবই স্পষ্ট ও সরল— অভাবের সংসারে লেখাপড়া বা খেলাধুলোর মতো ‘বাজে’ কাজে সময় নষ্ট না করে মেয়েরা যদি চটপট কিছু উপার্জন করতে পারে! মেয়ের ছবি নিয়ে বিভিন্ন প্রোডিউসার-পরিচালকদের দরজায় দরজায় ঘুরতেন আলি বক্স — ‘মেয়ে আমার দেখতে-শুনতে ভাল, নাচতে-গাইতে পারে, শিশুশিল্পী দরকার হলে জানাবেন।’

গত শতকের বিশের দশকের কোনও সময়ে স্ত্রী-সন্তানদের জন্মস্থান লাহৌরে রেখে মুম্বই পৌঁছন ভাগ্যান্বেষী আলি বকশ। মুম্বইয়ের থিয়েটারে পরিচয় হয় প্রভাবতী নামে এক বাঙালি-খ্রিস্টান নৃত্যশিল্পী, তথা নির্বাক ছবির এক হিরোইনের সঙ্গে। প্রচলিত জনশ্রুতি, প্রভাবতীর মা হেমসুন্দরী ছিলেন পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুর পরিবারের প্রথম পুরুষ দর্পনারায়ণ ঠাকুরের কোনও এক বংশধরের বধূ (বিভিন্ন লেখায় এমন উল্লেখ থাকলেও এর সপক্ষে কোনও বিশ্বাসযোগ্য নথি আমি পাইনি)। তবে, এটা ঘটনা যে, হেমসুন্দরী বাঙালি ছিলেন। অল্পবয়সে স্বামীকে হারিয়ে তিনি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে নার্সের চাকরি নিয়ে মেরঠে যান এবং সেখানে নতুন সংসার পাতেন। সেখানে তাঁর দুই কন্যাসন্তান জন্মায়, তাঁদেরই একজন প্রভাবতী। আলি বকশকে ‘নিকাহ’ করার আগে প্রভাবতী ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নেন, নতুন নাম হয় ইকবাল বেগম।

আলি বকশ ও ইকবালের তিন কন্যা। মেজ মেয়ে মীনার জন্মের তারিখ ১ অগস্ট। সাল ১৯৩২ অথবা ১৯৩৩। দ্বিতীয় এই সন্তানও কন্যা হওয়ায় ক্ষিপ্ত আলি বকশ সদ্যোজাত শিশুটিকে অনাথাশ্রমে ফেলে আসেন। পরে এক বন্ধুর গালমন্দ শুনে ফের বাড়িতে এনে নাম রাখেন মাহজ়বিন (অর্থাৎ,‘চন্দ্রমুখী’)।

শিশু মাহজ়বিনকে ছবিতে সুযোগ দেওয়ার সময়েই বিজয় ভট্ট আপত্তি তুলেছিলেন শিল্পীর নাম নিয়ে। মাহজ়বিন নামটা তাঁর কানে কর্কশ লেগেছিল সম্ভবত (ভুললে চলবে না, সে-কালে হিন্দি ছবিতে বহু মুসলিম অভিনেতা-অভিনেত্রী— বিশেষ করে অভিনেত্রীদের সর্বভারতীয় ‘দর্শক’দের কাছে ‘গ্রহণীয়’ করে তোলার জন্য হিন্দু নাম দেওয়া হত। যে-কারণে মহম্মদ ইউসুফ খান হয়েছিলেন ‘দিলীপ কুমার’, মুমতাজ জেহান দেহলভি হন ‘মধুবালা’, খুরশিদ আখতার হন ‘শ্যামা’, ইত্যাদি।), তাই তিনি সেই নাম পাল্টে করে দেন ‘বেবি মীনা’। পরের কয়েকটি বছর বেবি মীনার কর্মক্ষেত্র হয় হোমি ওয়াডিয়ার ‘বসন্ত স্টুডিয়ো’। ‘লক্ষ্মীনারায়ণ’, ‘শ্রী গণেশ মহিমা’, প্রভৃতি হিন্দু পৌরাণিক ছবিতে কাজ করতে থাকেন। ধর্মনিষ্ঠ সুন্নি মুসলিম পরিবারের বাচ্চা মেয়ে, হিন্দু শাস্ত্র-পুরাণ সম্পর্কে কোনও প্রাথমিক ধারণা না-থাকা সত্ত্বেও ওই সব পৌরাণিক ছবিতে বেবি মীনার সাবলীল অভিনয় খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। অনেকের মতে, ওঁর অভিনীত শ্রেষ্ঠ ছবি ‘সাহিব, বিবি অউর গুলাম’-এ ছোটি বহু-র চরিত্রেও এটাই হয়েছিল। কাহিনির সময়কাল উনিশ শতকের শেষ থেকে বিশ শতকের প্রথম দিক। সে-আমলের বাঙালি হিন্দু ক্ষয়িষ্ণু জমিদার পরিবারের রীতি-প্রথা-সংস্কারের সঙ্গে মীনা কুমারীর আজন্মলালিত সংস্কারের প্রভেদ অনেক। কিন্তু গোটা ছবিতে একমাত্র ওঁর অভিনয়েই সেই প্রভেদ মুহূর্তের জন্যও চোখে পড়ে না।


You might also like!