দুরন্তবার্তা ডিজিটাল ডেস্ক : রুপোলি পর্দার পিছনে তারকাদের সম্পর্ক নিয়ে জল্পনা-আলোচনার শেষ নেই। কখনও উত্তমকুমার বনাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সৌহার্দ্য, কখনও সত্যজিৎ রায় ও মৃণাল সেনের মতপার্থক্য, আবার কখনও বর্তমান প্রজন্মে দেব ও জিৎকে ঘিরে তুলনা—এইসব সম্পর্ক নিয়েই গড়ে উঠেছে বহু জনপ্রিয় গুঞ্জন।
তবে সময় বদলেছে, আর তার সঙ্গে বদলেছে বন্ধুত্বের প্রকাশভঙ্গিও। আজকের টলিপাড়া যেন এক নতুন ট্রেন্ডের সাক্ষী—সেখানে সহকর্মীদের কাজের প্রতি খোলামেলা প্রশংসা, সম্মান, ও সমর্থন দিচ্ছে সামাজিক মাধ্যমেই। এই সদর্থক মনোভাব কখনও একজন সহঅভিনেতার ছবির প্রচারে দেখা যায়, তো কখনও পুরস্কারজয়ীর প্রতি আন্তরিক শুভেচ্ছাবার্তায়।
বিনোদন জগতে টিকে থাকতে প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হয়। কেউ কাউকে এক চুল জমি ছাড়তে নারাজ। প্রচলিত ধারণা এমনই। সেখানে এক জন শিল্পী প্রকাশ্যে অন্যের প্রশংসা করছেন বা দর্শককে তাঁর কাজ দেখার আবেদন জানাচ্ছেন— এ হেন পদক্ষেপ পেশাদার বন্ধুত্বের নতুন কক্ষপথের দিকেই নির্দেশ করছে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। ধরা যাক চর্চিত ‘ক’ পরিচালকের ছবি বা কোনও ওয়েব সিরিজ় মুক্তি পেয়েছে। ‘খ’ পরিচালকও ইন্ডাস্ট্রিতে যথেষ্ট চর্চিত। এ দিকে সেই শুক্রবারে তাঁর কোনও ছবি মুক্তি পায়নি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সমাজমাধ্যমে তিনি ‘ক’-এর কাজ নিয়ে লিখেছেন এবং দর্শককে তা দেখার জন্য আবেদন জানিয়েছেন। এই রীতি প্রায় প্রতি শুক্রবারে টলিপাড়ায় এখন নজর কাড়ছে। কে কার ছবি বা সিরিজ় নিয়ে কী লিখছেন, সেই মতামতকেও গুরুত্ব দিয়ে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। বিষয়টিকে এক ধরনের ‘প্রচার’ বলেও দেখতে চান অনেকে। কেউ কেউ আবার সেটিকে অলিখিত নিয়ম বলেও দাগিয়ে দেন। কারণ এক জন লিখলে অন্যেরাও লিখবেন। আবার কে কার হয়ে কিছু লিখলেন না, তা নিয়েও চর্চা চোখে পড়ে। এর নেপথ্যে নেহাতই বন্ধুত্ব রয়েছে না কি ব্যবসায়িক কৌশল।
একটি ছোট্ট উদাহরণ দেওয়া যাক। সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে, পরিচালক অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরীর ছবি ‘ডিয়ার মা’। ছবিটির প্রশংসা করে সমাজমাধ্যমে পোস্ট করেছিলেন টলিপাড়ার আর এক পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়। অবশ্য এই প্রথম নয়, সৃজিত অনেকের কাজ নিয়েই সমাজমাধ্যমে লিখেছেন। তবে পরিচালকের যুক্তি, ‘‘আমি কিন্তু সকলের কাজ নিয়ে লিখি না। যে কাজটা ভাল লাগে, তা নিয়ে সমাজমাধ্যমে ব্যক্তিগত মতামত জানাই। তাই কোনও বাঁধাধরা নিয়ম নেই যে, আমাকে লিখতেই হবে।’’ বন্ধুত্বের দৌলতেই যে এই প্রশংসা, তা মানতে নারাজ সৃজিত। আবার এই তথাকথিত প্রচারের ফলে ছবির প্রতি দর্শকের আগ্রহ তৈরি হতে পারে বলেও তিনি মনে করছেন না। কারণ তাঁর কথায়, ‘‘টিজ়ার বা ট্রেলার প্রথমে দর্শকদের আগ্রহ তৈরি করে। ছবি যদি ভাল না হয়, তা হলে প্রচারে কোনও লাভ হয় না।’’ উল্লেখ্য, সৃজিতের পরিচালিত ‘পদাতিক’ ছবিতে সত্যজিৎ-মৃণালের বন্ধুত্বের বিভিন্ন দিক উন্মোচিত হয়েছে।
সমাজমাধ্যমে অন্যের কাজের প্রশংসা বন্ধু বৃত্তের বাইরেও হতে পারে। যেমন, বলিউডের ‘খুফিয়া’ ছবিতে বাংলাদেশি অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধনের অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে ব্যক্তিগত ভাবে মেসেজ করেছিলেন অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী। তাঁরা তো বন্ধু নন। আবার সম্প্রতি ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত পরিচালিত ‘গৃহপ্রবেশ’ ছবিটি নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেন অনিরুদ্ধ। এই প্রসঙ্গে তিনিও কিছুটা সৃজিতের পথেই হাঁটার পক্ষপাতী। তবে ‘শুভেচ্ছাবার্তা’ এবং ‘প্রশংসা’র মধ্যে পার্থক্য করতে চাইছেন তিনি। বললেন, ‘‘যে কাজটা ভাল লাগে না, সেটা নিয়ে আমি কিছু লিখি না। আমার ভাল লাগার মাধ্যমে এক জনও প্রভাবিত হলে সেটা তো ছবির লাভ।’’
অনেক সময়ে ইন্ডাস্ট্রির অন্দরে এ রকম কথাও শোনা যায়, অন্যের কাজের প্রশংসা না করলে, নিজের কাজের সময়ে কাউকে পাশে পাওয়া যায় না। অনিরুদ্ধ অবশ্য এই বক্তব্য সমর্থন করতে নারাজ। বরং কেউ তাঁকে তাঁর কাজ নিয়ে মতামত (ভাল বা খারাপ) জানালে, তিনি তা সাদরে গ্রহণ করেন। স্পষ্ট বললেন, ‘‘ছোট্ট একটা ইন্ডাস্ট্রি। দিনে দিনে হিন্দি এবং দক্ষিণী ছবির চাপে কোণঠাসা। সেখানে মনের মধ্যে হিংসে পুষে কী লাভ! ইন্ডাস্ট্রি এগোলে জানি আমিও এক ধাপ এগোব।’’
ইন্ডাস্ট্রিতে অভিনেতাদের মধ্যেও এই ধরনের পাশে থাকার বার্তা দিয়ে থাকেন অনেকেই। সাম্প্রতিক অতীতে সেখানে আলাদা করে নজর কেড়েছেন অঙ্কুশ। সম্প্রতি, সমাজমাধ্যমে দেব অভিনীত ‘রঘু ডাকাত’ ছবিটির টিজ়ারের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন তিনি। তবে এই প্রসঙ্গে দর্শককে ভুল পথে চালিত করতে নারাজ অঙ্কুশ। তিনি বলেন, ‘‘দর্শকের জন্যই আমরা। তাঁদের বিভ্রান্ত করতে পারব না। তাই কাছের কারও কোনও কাজ ভাল না লাগলে সেটা তাকে ব্যক্তিগত স্তরে জানাই। ফলে তিনি ভুল শুধরে নিতে পারেন।’’
সমাজমাধ্যমে প্রশংসার মাধ্যমে ইন্ডাস্ট্রিতে বন্ধুত্ব টিকে থাকে না বলেই বিশ্বাস করেন অঙ্কুশ। তাঁর মতে, কোনও শুভেচ্ছাবার্তা বা প্রশংসা মন থেকেই লেখা উচিত। অঙ্কুশ বললেন, ‘‘আসলে ‘খুব ভাল ট্রেলার, অনেক অনেক শুভেচ্ছা’— এই ধরনের পোস্ট দেখলে বোঝা যায় যে, কী ভাবে সেটা লেখা হচ্ছে।’’ আবার প্রশংসার মাধ্যমে মানুষ হিসেবেও যে আরও এক ধাপ এগোনো সম্ভব, সেই সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দিচ্ছেন না অঙ্কুশ। তাঁর যুক্তি, ‘‘এক জন প্রযোজক বা অভিনেতা হিসেবে আমি যা করতে পারিনি, সেটা অন্য কেউ করলে, তার পাশে থাকতে নিজেরও ভাল লাগে।’’
টলিপাড়ায় দীর্ঘ দিন কম বাজেটে ভাল ছবি তৈরি হচ্ছে। সে রকম কোনও প্রজেক্টের ‘পাশে দাঁড়ানো’-র নেপথ্যে কোনও ‘তত্ব’ খোঁজা উচিত নয় বলেই মনে করেন অনেকে। আবার, মুখ রক্ষার জন্য প্রিমিয়ারও অনেকে এড়িয়ে যান আজকাল। কারণ, প্রিমিয়ারে গেলেই নাকি ছবিকে ‘ভাল’ বলতে হয়! অঙ্কুশের কথায়, ‘‘‘মির্জ়া’র প্রিমিয়ারে দুটো প্রেক্ষাগৃহ ভরে মানুষ ছবিটা দেখেছিলেন। এই ধরনের ঘটনা তো সত্যিই মনের জোর বাড়ায়।’’
রুপোলি দুনিয়ার অন্দরে নানা সমীকরণের অবস্থান। সমাজমাধ্যমের দৌলতে সেখানে প্রতিযোগিতাপূর্ণ মনোভাবও বেড়েছে। ফলে বন্ধুত্বের সংজ্ঞা এখন পরিবর্তনশীল। মনোবিদ অনিন্দিতা মুখোপাধ্যায়ের প্রশ্ন, ‘‘উত্তম-সৌমিত্রের যুগে কি এত অভিনেতা বা কনটেন্ট ছিল? উত্তমকুমার কি কখনও ভেবেছিলেন তাঁকে দেখতে দর্শক প্রেক্ষাগৃহে যাবেন কি না।’’ কনটেন্ট এবং বিনোদনের বিভিন্ন মাধ্যমের ভারে ক্লান্ত দর্শকের সামনে পরস্পরের হিংসে বেরিয়ে এলে ইন্ডাস্ট্রির ক্ষতিই বেশি হতে পারে বলে জানালেন অনিন্দিতা।
যে কোনও ইন্ডাস্ট্রিতে স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবে এগোনোর ক্ষেত্রে ইতিবাচক। টলিপাড়ার ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। অনিন্দিতার কথায়, ‘‘প্রশংসা মন থেকে করা হচ্ছে কি না, তা আমার জানা নেই। কিন্তু মনোবিজ্ঞানে বলা হয়েছে, কোনও দলের মধ্যে দীর্ঘ সময়ে মতপার্থক্য থাকলে, সেই দল ভেঙে যায়। কঠিন সময়ে টিকে থাকার জন্য একে অপরের হাত ধরাও তো বন্ধুত্বের একটা রূপ।’’
সমাজমাধ্যমে শিল্পী বা পরিচালকেরা একে অপরের কাজ নিয়ে লেখার ফলে সিনেমার ব্যবসায় কি কোনও প্রভাব পড়ে? টলিপাড়ায় খোঁজ নিয়ে সে রকম কোনও ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ, এ কথা স্পষ্ট গত দশ বছরে বাংলা ছবির দর্শক কমেছে। সেখানে শুধু সমাজমাধ্যমে লিখে বা প্রচার করে কোনও ছবিকে ফিনিশিং লাইনে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব নয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টলিপাড়ার সঙ্গে যুক্ত এক ব্যক্তির সরস মন্তব্য, ‘‘বন্ধুত্বের খাতিরে অনেকেই প্রশংসা করেন। কিন্তু তার মাধ্যমে যদি ফ্লপ ছবি হিট হতো, তা হলে তো বাংলা ছবির ব্যবসা আরও বাড়ত!’’ এ প্রসঙ্গে প্রিয়া সিনেমা হলের কর্ণধার অরিজিৎ দত্তও জোর দিলেন ছবির বিষয়ভাবনা এবং দর্শকের উপর। একে অপরের কাজ নিয়ে সমাজমাধ্যমে লেখার নেপথ্যে নিখাদ বন্ধুত্ব রয়েছে বলেই তিনি আশা প্রকাশ করলেন। কিন্তু অরিজিতের পাল্টা যুক্তি, ‘‘‘সাইয়ারা’ তো কেউ প্রথমে দেখাতে চায়নি। কিন্তু কোনও প্রচার ছাড়াই ছবি সুপারহিট। তাই সব সময়ে বন্ধুত্ব দিয়ে বক্স অফিসে সাফল্য ব্যাখ্যা করা কঠিন।’’
সময়ের সঙ্গে রুপোলি দুনিয়ায় তৈরি হওয়া অস্তিত্বের সঙ্কট এ প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ। দর্শকের ‘অ্যাটেনশন স্প্যান’ কমেছে। ফলে এখন শিল্পের কাছে দর্শক নয়, বরং শিল্পকে দর্শকের কাছে পৌঁছে দিতে হয়। সেখানে প্রচার অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তবে তারও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কারণ, দিনের শেষে মেধা কথা বলে। কিন্তু অনিশ্চিত এবং বিপদসঙ্কুল ইন্ডাস্ট্রিতে কখনও কখনও বন্ধুত্ব বা সৌজন্যের খাতিরে পাশে থাকার অভ্যাস ইতিবাচক সংস্কৃতির দিকেই নির্দেশ করে।