
দূরন্ত বার্তা ডিজিটাল ডেস্ক: বিহারে ক্ষমতা ধরে রাখলেন নীতীশ কুমার। ২০২৫-এর বিধানসভা নির্বাচনের চূড়ান্ত ফল এখনও আসেনি, তবে প্রবণতা অনুযায়ী তাতে বড় কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা কম। শুধু ক্ষমতা নয়, শক্তিও বেড়েছে তাঁর। ২০২০-এর তুলনায় JDU প্রায় দ্বিগুণ আসন জিততে চলেছে। নির্বাচনের আগে নীতীশ কুমারের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল।
গত ২০ বছর ধরে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী পদে রয়েছেন নীতীশ কুমার। বেশির ভাগ সময় তিনি NDA-র নেতৃত্বে, কিছু বছর মহাগটবন্ধনের নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। দীর্ঘ সময় ধরে একই মুখ দেখার ক্লান্তি এবং প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার অভিযোগও ছিল। যদিও তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যক্তিগত অভিযোগ নেই, তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ব্যাপক অভিযোগ উঠেছে। এমনকি লালু প্রসাদের সময় ‘জঙ্গলরাজ’ চলত বলে যারা অভিযোগ করতেন, তাঁরা বলছেন লালুর সময় সরকারের দুর্নীতি নীতীশ সরকারের তুলনায় কম ছিল। সবচেয়ে বড় উদ্বেগ ছিল নীতীশের স্বাস্থ্য। বয়সজনিত কারণে মনে রাখার সমস্যা এবং কাজের ক্ষেত্রে ভুলের অভিযোগ উঠেছিল। তাঁকে ডাকতেন ‘ডুবতা সিতারা’, এমনকি JDU প্রধানের সঙ্গে প্রাক্তন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের তুলনাও করা হয়েছিল। এই সকল কারণেই সম্ভবত নির্বাচনে নীতীশের নেতৃত্বেই NDA লড়ছে বলে ঘোষণা করা হলেও, মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে তাঁর নাম ঘোষণা করেনি BJP। তবে তাঁকে নিয়ে করা সব অঙ্ক উল্টে গিয়েছে। বলা যেতে পারে উল্টে দিয়েছে ‘M’ ফ্যাক্টর।
এক সময়ে লালুপ্রসাদের ধারাবাহিক সাফল্যের কারণ বলা হতো ‘MY’ ফ্যাক্টর অর্থাৎ, মুসলিম-যাদব। আর নীতীশের ‘M’ হলো মহিলা। জাতপাতের রাজনীতির জন্য পরিচিত বিহারে তিনি এক অনন্য ভোট ব্যাঙ্ক তৈরি করে নিয়েছেন। আর এই ভোটব্যাঙ্কই এ বার বিহারে JDU তথা NDA-র চমকে দেওয়া ফলের সবথেকে বড় কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। এই ভোটব্যাঙ্ককে লক্ষ্য করেই তো ভোটের ঠিক আগে ‘ওস্তাদের মার’ দিয়েছিলেন নীতীশ: ‘মুখ্যমন্ত্রী মহিলা রোজগার যোজনা’। এই প্রকল্পে প্রতি পরিবারের একজন করে মহিলা ব্যবসা শুরুর জন্য প্রাথমিক খরচ হিসেবে ১০,০০০ টাকা করে পাবেন। তাদের ব্যবসা যদি চলে পরে আরও ২ লক্ষ টাকা করে দেওয়া হবে।
পরের ২ লক্ষ টাকা নীতীশ সরকার দিতে পারবেন কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তবে ২৬ সেপ্টেম্বর এই প্রকল্পের উদ্বোধন করেছেন প্রদানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আর সঙ্গে সঙ্গে ৭৫ লক্ষ মহিলার অ্যাকাউন্টে ১০,০০০ টাকা করে ঢুকে গিয়েছে। এটা ভোটের ফলে বড় প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিকর বিশ্লেষকরা। উল্টোদিকে মহাগটবন্ধনও মহিলাদের অর্থ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ‘মাই বহিন মান যোজনা’ চালু করবেন বলেছিলেন তেজস্বী। জানিয়েছিলেন গরিব ও পিছিয়ে পড়া মহিলাদের মাসে মাসে ২৫০০ টাকা করে দেওয়া হবে। তবে মহিলারা আস্থা রেখেছেন নীতীশের উপরেই। আসলে মহিলা ভোটব্যাঙ্ককে নিশানা করা তো ২০২৫-এ শুরু করেননি নীতীশ, বলা যেতে পারে ভারতীয় রাজনীতিতে তিনিই প্রথম মহিলা ভোটব্যাঙ্কের গুরুত্ব বুঝেছিলেন। ২০০৫ সালে প্রথমবার মুখ্যমন্ত্রী হয়েই স্কুলপড়ুয়া ছাত্রীদের জন্য সাইকেল ও স্কুল ইউনিফর্ম দেওয়ার প্রকল্প চালু করেছিলেন তিনি। এর ফলে মেয়েদের স্কুলে ভর্তি বেড়েছে, কমেছে স্কুলছুট হওয়ার সংখ্যা। আজও বিহারের গ্রামে গ্রামে মেয়েরা বলে, ‘বাবা আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছেন, আর নীতীশ দিয়েছেন সাইকেল।’ ২০১৬ সালে মহিলাদের স্বার্থে আরও এক বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নীতীশ, রাজ্যে মদ নিষিদ্ধ করা। মহিলাদের অভিযোগ ছিল, বাড়ির পুরুষরা মদ খেয়ে রোজগারের সব টাকা উড়িয়ে দেয়। তার পরে মত্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরে তাঁদের উপরে অত্যাচার শুরু করে।
রাজ্যের কোটি কোটি টাকা রাজস্ব বরবাদ করেও মদ নিষিদ্ধ করেছিলেন নীতীশ। তাতে রাজ্যে মদ একেবারে বন্ধ হয়ে গিয়েছে, তা বলা যাবে না। বরং বেআইনি ভাবে মদ কিনতে গিয়ে আরও বেশি টাকা খোয়াচ্ছেন বাড়ির পুরুষরা। তবে মহিলারা জানেন মদ বন্ধ করেছেন নীতীশই। এ ছাড়াও মহিলাদের জন্য পঞ্চায়েত থেকে পুলিশ, সব জায়গায় মহিলাদের জন্য সংরক্ষণও চালু করেছেন। বিহারে পঞ্চায়েতে ৫০ শতাংশ, সরকারি চাকরি ও পুলিশে ৩৫ শতাংশ করে আসন সংরক্ষিত তাকে মহিলাদের জন্য। তাই মহিলারাও নীতীশকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন। এই বছর তাঁর আসনে থাকা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও, মহিলারা বিপুল সংখ্যায় তাঁর পক্ষে ভোট দিয়েছেন। ফলস্বরূপ, মহিলাদের ভোটের হার রেকর্ডভাবে ৭১.৬ শতাংশ, আর পুরুষদের ভোট মাত্র ৬২.৯৮ শতাংশ। তবে মহিলাদের বেশি ভোট দেওয়ার এই প্রবণতা বিহারে ২০১০ সাল থেকে লক্ষ্য করা যায়। নীতীশ ‘পালটু চাচা’ বা ‘ডুবতা সিতারা’ খ্যাতি উপেক্ষা করে মহিলাদের আস্থা জিতে খেলা ঘুরিয়ে দিয়েছেন।
