West Bengal

2 days ago

Durgapur municipality:দুর্গাপুর পুরসভায় ১০ ওয়ার্ডে পিছিয়ে তৃণমূল, মুখ্যমন্ত্রীর রোষের মুখে পুরসভার প্রশাসকমন্ডলী

Durgapur municipality
Durgapur municipality

 

দুর্গাপুর  : লোকসভার ভোট মিটতেই রণংদেহী স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্য জুড়ে পুরসভার কাজকর্মে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর রোষের মুখ থেকে বাদ পড়েনি শিল্পশহর দুর্গাপুর। রীতিমতো 'অপদার্থ' বলে কড়া সমালোচনা করেছেন দুর্গাপুরের পুর প্রশাসকমন্ডলীকে। একই সঙ্গে শহরের বিভিন্ন কারখানায় চাঁদা তোলা বন্ধ করারও নিদান দিয়েছেন পুলিশকে। আর তাতেই চরম অস্বস্তিতে দুর্গাপুরের ঘাসফুল শিবির। প্রশ্ন, লোকসভা ভোটের পরই কেন এমন রোষানল? মুখ্যমন্ত্রীর এই রণংদেহি মুর্তিকে কটাক্ষ করেছে বিরোধীরা।

প্রসঙ্গত, লোকসভা নির্বাচন মিটতেই পুরভোট ও আগামী বিধানসভা ভোটকে পাখির চোখ করেছে তৃণমূল নেত্রী মমতাবন্দ্যোপাধ্যায়। ফলাফলের নিরিখে রিভিউ কাজ শুরু করেছেন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং। সোমবার ও বৃহস্পতিবার নবান্নের সভাঘরে বৈঠকে পুর প্রধান, আমলা, দলের জনপ্রতিনিধিদের তুলোধনা করেন মুখ্যমন্ত্রী। তাতে পুরসভাগুলির কাজকর্মে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। শিলিগুড়ি, দুর্গাপুর, হাওড়া, বিধাননগরের মতো বড় পুরনিগমগুলির নামও করেন। দুর্গাপুরে শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসির বিরুদ্ধে তোলাবাজির অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন সময়ে। অতীতে মুখ্যমন্ত্রী দুর্গাপুরে এসে প্রশাসনিক বৈঠকে এবিষয়ে শ্রমিক নেতৃত্বকে সতর্ক করে গিয়েছেন। বৃহস্পতিবার নবান্নের সভাঘর থেকে ফের সরব হলেন তিনি। এদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "জুলুম চলছে দুর্গাপুরে। কারখানায় চাঁদা তোলার। যারা যারা চাঁদা তুলছে, তাদের হাতগুলো একটু বন্ধ করো। লোকাল পুলিশকে কড়া ব্যবস্থা নিতে হবে। পুলিশ নড়বড়ে হলে চলবে না।" একই সঙ্গে এদিন মুখ্যমন্ত্রী দুর্গাপুর পুরসভার কাজ নিয়েও তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, "দুর্গাপুরে ছয় জন আছে। সবাই অপদার্থ। একজন ছাড়া। তাদের বদলে নতুনদের নিতে হবে। ভালো লোক খোঁজো। পুলিশকে বলো ক্রস চেক করে নিতে। পুলিশ অনেক সময় নেতাদের কথায় উল্টোপাল্টা ক্রস চেক করে তথ্য দেয়। ওসব চলবে না। সঠিক তথ্য চাই।" দুর্গাপুর নগর নিগম পাঁচজন প্রশাসক মন্ডলীর দ্বারা পরিচালিত। অনিন্দিতা মুখোপাধ্যায় মুখ্য প্রশাসক তার পৌরহিত্যে আরও যে চারজন প্রশাসক মন্ডলীতে রয়েছেন তারা হলেন অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়, রাখি তিওয়ারি, ধর্মেন্দ্র যাদব এবং দীপঙ্কর লাহা। আর প্রশ্ন এখানেই। লোকসভা ভোটের ফলাফলের পরই কেন প্রশাসকমন্ডলী থেকে দলের শ্রমিক নেতাদের ওপর এহেন ক্ষোভ উগরে দিলেন?

উল্লেখ্য, লোকসভা ভোটের ফলাফল প্রকাশের পর দেখা গিয়েছে রাজ্যের ১২৬টি পুরসভা ও পুরনিগমের মধ্যে বেশির ভাগেই পিছিয়ে রয়েছে তৃণমুল। রাজ্যজুড়ে ঘাসফুলের ঝড় থাকলেও, শিল্পশহরে বয়ছে গেরুয়া হাওয়া। লোকসভায় দুর্গাপুরে দুই বিধানসভা ভিত্তিক ফলাফলে ব্যাবধান কমলেও, প্রায় সব ওয়ার্ডেই এগিয়ে বিজেপি। পুরসভার ৪৩ টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৩৩ টি ওয়ার্ডে তৃণমূল থেকে মুখ ফিরিয়েছে শহরবাসী। হাতে গোনা ১০ ওয়ার্ডে এগিয়ে আছে ঘাসফুল।

গত ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে দুর্গাপুর পশ্চিম বিধানসভা কেন্দ্রে বিজেপি ৪৯,৫১১ ভোটের এগিয়ে ছিল। দুর্গাপুর পূর্বে ২৬,৫৯১ ভোটে এগিয়ে ছিল। ওয়ার্ড ভিত্তিক ফলাফলে শহরে ৪৩ টি ওয়ার্ডের মধ্যে হাতে গোনা দুটি ওয়ার্ডে এগিয়েছিল তৃণমূল। ২০২৪ লোকসভা ভোটে বিধানসভা ভিত্তিক ফলাফলে গতবারের চেয়ে ব্যবধান অনেকটাই কমেছে।

পুর এলাকার ৪৩টি ওয়ার্ড থেকে মোট ১৩,০৫৪ ভোটে এগিয়ে বিজেপি। লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর রাজ্য জুড়ে যখন ঘাসফুলের ঝড় সেই সময় দুর্গাপুরে পদ্মফুলের হাওয়া বইছে। দুর্গাপুর পুর এলাকার মানুষ তৃণমূলের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। পুরসভার ৪৩ টি ওয়ার্ডের মধ্যে মাত্র ১০ টি ওয়ার্ডে লিড পেয়েছে তৃণমূল। বাকি ৩৩ টি ওয়ার্ডে লিড পেয়েছে বিজেপি। এই ফল অস্বস্তিতে ফেলেছে তৃণমূল নেতৃত্বকে। পুরভোটে ক্ষমতা ধরে রাখতে তৃণমূলকে অন্তত ২২টি ওয়ার্ডে জয় পেতে হবে।

দুর্গাপুরে দুটি বিধানসভা কেন্দ্র। একটি পূর্ব ও আর একটি পশ্চিম। দুর্গাপুর পশ্চিম বিধানসভার মধ্যে রয়েছে ২৭টি এবং দুর্গাপুর পূর্বের মধ্যে রয়েছে শহরের বাকি ১৬টি ওয়ার্ড। পূর্ব কেন্দ্র থেকে ১ হাজার ৬৯৩ ভোটে তৃণমূল লিড পেয়েছে। কিন্তু, ১১ হাজার ৬৮২ ভোটে তৃণমূল হেরেছে পশ্চিম কেন্দ্র থেকে। দুর্গাপুর পুর এলাকায় বিজেপি পেয়েছে ৪৫.২৩ শতাংশ ভোট। তৃণমূল পেয়েছে ৪১.৪৫ শতাংশ ভোট। বামেদের ঝুলিতে পড়েছে ৯.৯৬ শতাংশ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দুর্গাপুর পশ্চিমের ২৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে তৃণমূল এগিয়ে রয়েছে মাত্র ৬টিতে (১২, ১৪, ৩১, ৩৪, ৩৫ ও ৪১ নম্বর ওয়ার্ডে)। এর মধ্যে ১২ নম্বর ওয়ার্ডে সর্বোচ্চ ১,৯৬৯ এবং ৩৪ নম্বরে সর্বনিম্ন ৪৩ ভোটের ‘লিড’ পেয়েছে তৃণমূল। দুর্গাপুর পূর্বের ১৬টি ওয়ার্ডের মধ্যে তৃণমূল এগিয়ে মাত্র ৪টিতে (১, ২, ২৩ ও ২৫ নম্বর ওয়ার্ডে)। এর মধ্যে ১ নম্বর ওয়ার্ডে সর্বোচ্চ ১,৭৯৮ এবং ২৫ নম্বরে সর্বনিম্ন ৩৯১ ভোটের ‘লিড’ রয়েছে। বর্তমান পুরসভার মুখ্য প্রশাসক অনিন্দিতা মুখোপাধ্যায়ের ২২ নম্বর ওয়ার্ডে ১৩৫১ ভোটে লিড পেয়েছে বিজেপি। সহকারি প্রশাসক অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৫ নম্বর ওয়ার্ড থেকে লিড পেয়েছে বিজেপি। প্রশাসক মন্ডলীর সদস্য ধর্মেন্দ্র যাদবের ওয়ার্ডে ১৮৯২ ভোটে লিড পেয়েছে বিজেপি। অন্যদিকে প্রশাসক মন্ডলীর দুই সদস্য রাখি তিওয়ারি ও দীপঙ্কর লাহা নিজেদের ওয়ার্ড থেকে দলকে লিড দিতে সমর্থ হয়েছেন। এবারের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির ভরাডুবি হবে তা অতিবড় তৃণমূল কর্মী ও নেতারা বুঝতে পারেননি। মাত্র ১২ টি আসনে আটকে গেছে বিজেপি। তৃণমূল পেয়েছে ২৯ টি আসন। কার্যত তৃণমূলের ঝড় বলাই চলে। এই অবস্থায় দুর্গাপুরে বিপরিত ছবি কেন? কী কারণে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তা জানার জন্য এখনও কাটাছেড়া শুরু করেননি তৃণমূল নেতৃত্ব। তবে দ্রুত পরাজয়ের কারণ খোঁজা শুরু করেছে জেলা থেকে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব। কারণ আগামী আগষ্ট মাসে পুরভোট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

উল্লেখ্য,দুর্গাপুর পুরসভার বোর্ডের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছে ২০২২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। পর দিন থেকে পুরসভার দায়িত্ব গিয়েছে ৫ সদস্যের প্রশাসকমণ্ডলীর হাতে। তার পরে কেটে গিয়েছে প্রায় ১ বছর ৯ মাস। এখনও নির্বাচন ঘোষণা হয়নি। দ্রুত পুরভোটের দাবিতে বিরোধীরা বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন করেছে। কিন্তু দুর্গাপুরের পুরভোট নিয়ে রাজ্য সরকারের তরফে কোনও উচ্চবাচ্য শোনা যায়নি। জল্পনা তৈরি হয়েছিল, লোকসভা ভোট না মিটলে এই পুরভোট হবে না। বিরোধীদের অভিযোগ, ২০১৭ সালে চরম সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করে ৪৩টি ওয়ার্ড দখল করেছিল তৃণমূল। যদিও তৃণমূল তা মানতে নারাজ। কিন্তু বিরোধীদের দাবি, ২০১৭ সালে পুরভোটের সন্ত্রাস মাথায় রেখেই তৃণমূলের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে শহর। তৃণমূলের নিচু তলার কর্মীদের বক্তব্য, স্বচ্ছ ভোট হলে পুরসভায় ভরাডুবি হবে। কিন্তু কেন পুর এলাকার মানুষ তৃণমূলের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল ? তাহলে কি পুর পরিষেবায় কোনও খামতি আছে ? অনেকই বলছেন, ‘অবশ্যই খামতি রয়েছে। না হলে কেন মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেবে। ঠান্ডা ঘরে বসে পুরসভা পরিচালনা করা যায় না। রাস্তার বেরিয়ে এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাদের অভাব অভিযোগ শুনতে হবে। কোনও এলাকায় আবর্জনা জমে আছে, কোথায় রাস্তার ওপর কালভার্ট ভেঙে আছে এসব দেখতে হবে। দুর্গাপুর নগর নিগমের ১৩ নং ওয়ার্ডের প্রাক্তন কাউন্সিলার তথা প্রশাসকমন্ডলীর সদস্য ধর্মেন্দ্র যাদব। তিনি অবশ্য বলেন," নিশ্চয় কিছু খামতি মনে করেছেন। যেটা আমাদের নজরে পড়েনি। গার্জেন হিসাবে এভাবে বলতেই পারেন। আমরা কাজ করছি। আরও ভালো কাজ, আরও ভালো পরিষেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি।"্

বিজেপির বর্ধমান-দুর্গাপুর সাংগঠনিক জেলার সহ সভাপতি চন্দ্রশেখর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন," আমরা বিরোধীরা যা বলি মুখ্যমন্ত্রীও তা বলছেন। তোলাবাজি তো আছেই। শ্রমিকদের কাছ থেকেও প্রতি মাসে কাটমানি খায় আইএনটিটিইউসি নেতারা। আর, শহরে পুরসভার পরিষেবায় মানুষ বিরক্ত। লোকসভা ভোটের ফলাফল সেটা প্রমান করছে। তৃণমূল নেত্রী সেটা ভালই টের পেয়েছেন। তাই, শুদ্ধিকরনের বার্তা দিচ্ছেন। তবে, দুর্গাপুরের মানুষ মন থেকে স্থির করে নিয়েছে, তৃণমূল বোর্ড চায় না। পুরভোট হলে সেটা স্পষ্ট হয়ে যাবে।" নেত্রীর "অপদার্থ" তকমাকে আশীর্বাদ বলে দুর্গাপুর পুরসভার মুখ্য প্রশাসক অনিন্দিতা মুখোপাধ্যায় বলেন," উন্নয়নের কাজ ১০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শহরবাসীর সেবায় কাজ করে চলেছি। তাই এটা হয়তো অচিরেই প্রসংশিত হবে। মুখ্যমন্ত্রী যেটা বলেছেন, সেটা ভালোবাসার আশীর্বাদ। মায়ের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে আগামীদিনে আরও ভালো পরিষেবা শহরবাসীকে দেবো।"

You might also like!