দূরন্ত বার্তা ডিজিটাল ডেস্ক: প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগারের দুর্গাপুজোর ইতিহাস শুধু একটি ধর্মীয় আচার নয়, বরং তা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিরোধ, জাতীয়তাবাদের উন্মেষ এবং আধুনিক কারাব্যবস্থার ভেতর সামাজিক পুনর্গঠনের এক প্রতীকী দলিল। ঔপনিবেশিক যুগে এই পুজো রাজনৈতিক বন্দিদের মধ্যে দেশপ্রেম ও ঐক্যের সঞ্চার ঘটিয়ে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার এক অভিনব মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। যদিও ব্রিটিশরা আধুনিক কারাব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে অপরাধ দমন ও শৃঙ্খলা রক্ষার উদ্দেশ্য নিয়েছিল, টমাস ব্যাবিংটন ম্যাকাওলের উদ্যোগে ১৮৩৮ সালে গঠিত প্রিজন ডিসিপ্লিন কমিটি এই ব্যবস্থাকে আইনি কাঠামোও দিয়েছিল, কিন্তু বাস্তবে তা রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন করার এক ভয়ঙ্কর অস্ত্রে পরিণত হয়। কারাগার হয়ে ওঠে শৃঙ্খলার কেন্দ্র নয়, বরং চরম নির্যাতন ও নিপীড়নের অঙ্গন, যেখানে রাজনৈতিক বন্দিদের উপর শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা ছিল নিত্যদিনের বাস্তবতা।
ঐতিহাসিক কারা-সাহিত্যে বন্দি জীবনের যন্ত্রণা স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে। নজরুলের রাজবন্দির জবানবন্দি থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা—সবই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সঙ্গে ঔপনিবেশিক কারাব্যবস্থার বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবাদের দলিল। ব্রিটিশরা বন্দিদের স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে চাইলেও, যেমন সুভাষচন্দ্র বসুকে মান্দালয়ে পাঠানো হয়েছিল, বিপ্লবীরা অনশন ধর্মঘট ও আইনি আবেদন করে লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন। সুভাষচন্দ্র বসুর দুর্গাপুজো আয়োজনের আবেদনও কেবল ধর্মীয় অধিকার নয়, বরং ঔপনিবেশিক কর্তৃপক্ষের ক্ষমতার বিরুদ্ধে এক অহিংস প্রতিরোধের কৌশল ছিল।
প্রেসিডেন্সি জেলের দুর্গাপুজো আয়োজনের একটি শক্তিশালী ঐতিহাসিক পটভূমি রয়েছে, যার মূল ভিত্তি ছিল ১৯২৫ সালে ২৩-২৭ সেপ্টেম্বর ব্রহ্মদেশের মান্দালয় জেলে সুভাষচন্দ্র বসুর নেওয়া উদ্যোগ। মান্দালয় জেলে বন্দি থাকাকালীন তিনি সহকর্মীদের নিয়ে দুর্গাপুজো করার প্রস্তাব দেন এবং জেল সুপারিনটেনডেন্ট মেজর ফিন্ডলের কাছে আবেদন করে অনুমতি আদায় করেন। এটি ছিল তৎকালীন কারা-বিধির মধ্যে এক ব্যতিক্রমী ঘটনা। এই পূজার বাজেট ছিল প্রায় ৭০০ টাকা, যার মধ্যে ৫০০ টাকা সরকার থেকে দেওয়ার মৌখিক প্রতিশ্রুতি ছিল। তবে, পুজোর খরচ নিয়ে কর্তৃপক্ষ ও বন্দিদের মধ্যে ব্যাপক মতভেদ ও অসন্তোষ হয়, যা পরবর্তীতে ১৯২৬ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে অনশন ধর্মঘট পর্যন্ত গড়িয়েছিল।
এই ঘটনা স্পষ্ট করে যে, বন্দিদের কাছে উৎসব পালন কেবল একটি ধর্মীয় চাহিদা ছিল না, বরং এটি তাদের অধিকার আদায়ের একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার। সুভাষচন্দ্র বসু দেবী দুর্গাকে দেশমাতার অভিন্ন রূপক হিসেবে দেখতেন এবং পুজোকে মাতৃশক্তির আরাধনা হিসেবে বর্ণনা করেন। এই ধারাবাহিকতায়, ১৯৪০ সালে প্রেসিডেন্সি জেলে থাকাকালীন সুভাষচন্দ্র বসু সেখানে দুর্গাপুজোর আয়োজন করেন। এই পুজোয় তার সঙ্গী ছিলেন বিপ্লবী নরেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তী, যিনি পরবর্তীকালে তার স্মৃতিচারণায় এই ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করেন। নরেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তীর বর্ণনায় এই পূজাকে ‘সন্ধিপূজা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এটি একটি গভীর প্রতীকী অর্থ বহন করে। এটি কেবল দেবী চামুণ্ডার চণ্ড ও মুণ্ড বধের পৌরাণিক ঘটনা নয়, বরং এটি সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক জীবনের এক সন্ধিক্ষণকে নির্দেশ করে। এই পুজোর মাধ্যমে সুভাষচন্দ্র যেন তার সহবন্দি ও দেশবাসীকে চিরবিদায় জানিয়েছিলেন, যা তার ভারতের মাটিতে শেষ বিপ্লবী কার্যকলাপ এবং বৃহত্তর আন্তর্জাতিক সংগ্রামে তার প্রস্থানের পূর্বাভাস দেয়। সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে মান্দালয় ও প্রেসিডেন্সি জেলে দুর্গাপুজো আয়োজন ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বিপ্লবীদের সম্মিলিত প্রতিরোধের এক সুদূরপ্রসারী কৌশল। ঔপনিবেশিক কারাব্যবস্থা যেখানে বন্দিদের বিচ্ছিন্ন ও অধিকারহীন করতে চেয়েছিল, সেখানে দুর্গাপুজোর আয়োজন ছিল তাদের প্রশাসনিক কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে এক ধরনের বিজয়। দুর্গাপুজোকে দেশমাতার আরাধনার সঙ্গে যুক্ত করে বন্দিদের মধ্যে দেশাত্মবোধ ও ঐক্যের চেতনা জাগিয়ে তোলা হল, যা হয়ে উঠল ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের এক সুচিন্তিত রূপক।
সুভাষচন্দ্র বসু দেবী দুর্গাকে দেশমাতার অভিন্ন রূপক হিসেবে উপস্থাপন করেন এবং সেই দৃষ্টিভঙ্গি তৎকালীন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। পুজোর মূল দর্শন, অর্থাৎ অশুভ শক্তির (অসুর) বিনাশ করে শুভ শক্তির (দেবী) প্রতিষ্ঠা, ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের একটি শক্তিশালী রূপক হয়ে ওঠে। এই আন্দোলন কারাগারের অভ্যন্তরেও ছড়িয়ে পড়ে, সহবন্দিদের মধ্যে উৎসব পর্যায়ে গোপনে ঐক্য, দেশপ্রেম এবং প্রতিরোধের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া হত। এটি ছিল কারা-অভ্যন্তরে ‘সর্বজনীন’ পূজার ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করার একটি প্রচেষ্টা, যা বন্দিদের মানসিক সংহতি ও দেশাত্মবোধকে জাগিয়ে তুলত। ঔপনিবেশিক আমলের রাজনৈতিক প্রতিরোধের প্রতীক থেকে বেরিয়ে এসে আধুনিক যুগে প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগারের দুর্গাপুজো সামাজিক অন্তর্ভুক্তিকরণ ও পুনর্বাসনের একটি প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই পূজায় বিভিন্ন সামাজিক থিম বা ভাবনা তুলে ধরা হয়। যেমন, ২০২৪ সালের থিম ছিল ‘মুক্তি’, যা বন্দিদের মনের গভীরে লুকানো মুক্তির আকাঙক্ষাকে তুলে ধরে। এটি শুধু শারীরিক মুক্তির কামনা নয়, বরং মানসিক ও আধ্যাত্মিক মুক্তির এক প্রতীকী প্রকাশ। ২০২৩ সালের থিম ‘নারী সাক্ষরতা ও স্বাস্থ্যই সম্পদ’, বন্দিদের সামাজিক সচেতনতা এবং শিক্ষার গুরুত্বের প্রতি আগ্রহের প্রতিফলন ঘটায়। একই বছর ‘এক টুকরো গ্রাম বাংলা’ থিমটি বন্দিদের নিজেদের শেকড়ের প্রতি টান এবং বাইরে থাকা পরিচিত জীবনের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ ছিল।
এই আধুনিক পুজোয় বন্দিরাই প্রতিমা নির্মাণ, মণ্ডপ সজ্জা এবং থিম সাজানোর দায়িত্ব পালন করেন। এটি তাদের সৃজনশীলতা ও আত্মমর্যাদা পুনরুদ্ধারের একটি সুযোগ করে দেয়। পূজার কয়েকদিন বন্দিদের জন্য বিশেষ ভোজের আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন দিনের মেনুতে থাকে ফ্রায়েড রাইস, বিরিয়ানি, মটন কারি, মাছের বিভিন্ন পদ, লুচি-তরকারি ও মিষ্টি। এই বিশেষ ভোজের উদ্দেশ্য হলো উৎসবের আনন্দ ভাগ করে নেওয়া এবং বন্দি-জীবনের একঘেয়েমি দূর করে তাদের মধ্যে মানসিক স্বস্তি ও আনন্দ ফিরিয়ে আনা। প্রেসিডেন্সি জেলের দুর্গাপূজার এই বিবর্তন একটি বৃহত্তর সামাজিক পরিবর্তনের প্রতিফলন।
ব্রিটিশ আমলে এটি ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিরোধের একটি অস্ত্র, আর আধুনিক যুগে এটি সংশোধনাগার ব্যবস্থার পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার একটি অপরিহার্য অংশ। স্বাধীন ভারতের সংশোধনাগার ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হল বন্দিদের মানসিক ও সামাজিক পুনর্বাসন নিশ্চিত করা। তাই, উৎসবের মাধ্যমে তাদের সৃজনশীলতা, আত্মমর্যাদা ও সামাজিক সংহতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়। প্রেসিডেন্সি জেলের পাশাপাশি রাজ্যের অন্যান্য সংশোধনাগারেও দুর্গাপূজা পালিত হয়, যা এই ঐতিহ্যের ব্যাপকতা প্রমাণ করে। আলিপুর সংশোধনাগারেও দীর্ঘদিন ধরে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এখানেও বন্দিরাই পূজার আয়োজন ও সৃজনশীল কাজগুলো করে থাকে। ২০১৭ সালে আলিপুর জেলের পূজার থিম ছিল ‘বিশ্ববাংলা, কন্যাশ্রী এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি’। এই থিমের মাধ্যমে সেখানে হিন্দু-মুসলমানের কোলাকুলির মূর্তি তৈরি করা হয়েছিল, যা সামাজিক সংহতির এক শক্তিশালী বার্তা বহন করে। চন্দন চন্দ নামের এক যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত বন্দি প্রতিমা ও মণ্ডপ তৈরির কাজ করে ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করেন। তিনি তার উপার্জিত অর্থ বন্দিদের কল্যাণ তহবিলে জমা দেন, যা বন্দিদের সন্তান ও অসুস্থ পরিবারের সদস্যদের জন্য ব্যবহৃত হয়।
ঔপনিবেশিক যুগে মান্দালয় ও প্রেসিডেন্সি জেলের পূজার মূল লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক প্রতিরোধ ও বন্দিদের মধ্যে দেশাত্মবোধ জাগরণ। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল বৈরী এবং অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে ভরা। পক্ষান্তরে, আধুনিক প্রেসিডেন্সি ও আলিপুর (অধুনা বারুইপুর) সংশোধনাগারের পূজাগুলোর লক্ষ্য মূলত সামাজিক অন্তর্ভুক্তিকরণ ও পুনর্বাসন। এখানে এখন বন্দিদের সৃজনশীল কাজ, থিমভিত্তিক মণ্ডপ এবং উন্নতমানের ভোজের ব্যবস্থা করা হয়। কর্তৃপক্ষের ভূমিকা এখানে ইতিবাচক ও সহযোগিতামূলক। প্রেসিডেন্সি জেলের দুর্গাপূজার ইতিহাস একটি অসাধারণ ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক দলিল। এটি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের এবং আধুনিক রাষ্ট্রের সামাজিক পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার এক সূক্ষ্ম প্রতিচ্ছবি। ঔপনিবেশিক আমলে সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে এই পূজা ছিল দেবী দুর্গাকে দেশমাতা হিসেবে আহ্বান করার একটি রাজনৈতিক কৌশল, যা বন্দিদের মধ্যে ঐক্য ও দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তুলেছে। দেবীপূজা ছিল কারা-অভ্যন্তরে ‘সর্বজনীন’ পূজার ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করার এক প্রচেষ্টা, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কারাব্যবস্থার দমনমূলক নীতির বিরুদ্ধে বন্দিদের অধিকার ও মানবিক মর্যাদার এক প্রতীকী লড়াই।
আধুনিক সময়ে, এই ঐতিহ্য পরিবর্তিত হয়েছে। প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগারে এখন এই পূজা বন্দিদের সৃজনশীলতা বিকাশের, সামাজিক থিম নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার এবং উৎসবের আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার একটি মাধ্যম। ‘মুক্তি’ বা ‘নারী সাক্ষরতা’র মতো থিমগুলো প্রমাণ করে যে, এই পূজাগুলো বন্দিদের মানসিক ও সামাজিক পুনর্বাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। মান্দালয় থেকে প্রেসিডেন্সি এবং সেখান থেকে আলিপুর হয়ে পশিমবঙ্গের প্রতিটি সংশোধনাগারের পূজার ধারাবাহিকতা প্রমাণ করে যে, এই ঐতিহ্যটি কেবল স্থান বা সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বাংলার সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা কারা-জীবনেও তার গভীর প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। এই উৎসবের মাধ্যমে কারাগার কেবলই সাজাভোগের জায়গা নয়, মানবিক মূল্যবোধ ও সামাজিক সংহতির এক অনন্য কেন্দ্র তথা সংশোধনাগার হিসেবে নিজেদের পরিচিতি তুলে ধরেছে।