দুর্গাপুর: ভেজাল! দুধ থেকে সরষের তেল। হলুদ থেকে পোস্তর দানা। নকলের দাপটে আসল খুঁজতে হোঁচট খাচ্ছে আমজনতা। এবার পৌষপার্বনে চিনির দাপটে উধাও রসনাতৃপ্তি খাবার নলেনগুড়ের সুগন্ধ ও স্বাদ। মুনাফার টানে অবাধে নলেনগুঁড়ে মিশছে চিনি। নজরদারি শিকেয়। আর সেটাই তৃপ্তি মেটাতে ঠান্ডার মরশুমে আপন করছে খাদ্যরসিক বাঙালি।
ডিসেম্বরের গোড়ায় শীতের শুরুতেই জঙ্গলমহল সহ জেলার বিভিন্ন (খেজুর গাছে ভরা) এলাকায় মহলদার বা গুঁড় তৈরি কারিগরদের আগমণ হয়। প্রাপ্ত বয়স্ক সাবলিল খেজুর গাছের ডালপালা কেটে রস নিঃসরণের উপায় করা হয়। বাঁশের গুজি বা নল ঠুকে রাখা হয়। সেটা দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা খেজুর রস বেরিয়ে আসে। তাই খেজুড়গুড়কে নলেনগুড় বলা হয় বলে মনে করেন অনেক। তার স্বাদ অতুলনীয়। তাতে ভাঁড় টাঙিয়ে রস সংগ্রহ করা হয়। কাকভোরে ওই রসভর্তি ভাঁড় মহলদাররা একত্রিত করে মহল বা ভাঁটিতে নিয়ে আসে। সেখানে অ্যালুমনিয়ামের বিশালাকার ডেগচি বা নৌকায় আগুনের তাপ দিয়ে ফোটানো হয়। বেশ কয়েক ঘন্টা ফোটানোর পর তৈরি হয় বাদামী রংয়ের খেজুর গুড় বা নলেন গুড়। বিশেষ কারিগরি প্রক্রিয়া সেটা উন্নতমানের করা হয়। তরল গুড়কে ঝোলা গুড় বলা হয়। এছাড়াও ওই গুড়কে কারিগরি প্রক্রিয়ায় করা হয় বিভিন্ন আকৃতির পাটালি। তারপর ওই গুড় টিন কিম্বা প্যাকেটজাত হয়ে সোজা বাজারে চলে যায়। মুলত পৌষ সংক্রান্তির পিঠেপার্বনে নলেনগুঁড় বেশী জনপ্রিয়। আবার নলেনগুঁড়ের রসগোল্লা, মিস্টি, পায়েসও জনপ্রিয়। কাঁকসা, লাউদোহা, অন্ডাল, আউশগ্রামের বিস্তির্ন জঙ্গলমহলে খেজুর গুড় বা নলেন গুড় তৈরীর কারিগর বা মহলদাররা অস্থায়ী ভাঁটি তৈরি করে বসে। কালিপুজোর পর থেকে খেজুরগাছ কাটিং করে রস নিঃসরণের প্রস্তুতি শুরু হয়। কাঁকসার বনকাটি, ত্রিলোকচন্দ্রপুর, মলানদিঘী, গোপালপুর, সহ কমবেশী ২০-৩০ টা গুড় তৈরি ভাঁটি বা মহল তৈরী হয়। জাতীয় সড়কের দুপাশে কাঁকসার বিরুডিহা এলাকায় তৈরী হয় ৪-৫টি মহল। পানাগড় দার্জিলিং মোড়েও তৈরী হয় মহল।
এখন প্রশ্ন, বর্তমান বাজারজাত নলেনগুঁড়ের গুনমান কতখানি সুস্বাদু। কাঁকসার জঙ্গলমহলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মহলদার বেমালুম বলেই ফেললেন, ভোর থেকে যা পরিশ্রম হয়, তাতে খাঁটি গুঁড় তৈরি করে মুনাফা তেমন আসে না। তাছাড়া অনেকের দাম শুনলে চোখ কপালে উঠে যায়। তাই দাম নাগালের মধ্যে রাখতে চিনির মিশ্রিন দিতে হয়। তাতে কিছুটা হলেও মুনাফা দেখতে পাওয়া যায়।" তবে কিভাবে দেওয়া হয় চিনি? জানা গেছে, বেশীর ভাগ মহলে শ'দেড়ক খেজুর গাছ কাটিং করে। তার মধ্যে ৫০ টা করে গাছের রস পর্যায়ক্রমে সংগ্রহ করে। সারাদিনে দু-বার। ৫০ টা গাছের ৩০ ভাঁড় ভর্তি রস হয়। তাতে গুড় হয় প্রায় ৫০ কেজি। শ্রমিক লগে ১০-১২ জন। তার ওপর জ্বালানির খরচ রয়েছে। তাই খরচের জেরে খাঁটি গুঁড় তৈরীতে মুনাফা তেমন থাকে না। খাঁটি ঝোলা গুঁড়ের দাম প্রায় ২০০ টাকা কেজি। চালু ঝোলা নলেন গুঁড় ৮০-১২০ টাকা কেজি দরে বিকোচ্ছে।
এবার প্রশ্ন এই দামে কিভাবে দেয়? জানা গেছে, চালু নলেন গু়ঁড়ের আর্ধেক দাম চিনির। ৩০ ভাঁড় রসের গুড়ে কমবেশী ১৫-২০ কেজি চিনি মেশানো হয়। তাতে গুঁড়ের পরিমান যেমন ৮-১০ কেজি বেশী হয়। তেমনই অতি সহজে দানা তৈরী হয়। এবং মুনাফার পরিমান থাকে গুড় তৈরি মহলদার বা কারিগরদের। আর এই চিনির মিশ্রনে খাঁটি গুড়ের মঁ মঁ করা সুগন্ধ উধাও হয়ে যায় যেমন, তেমনই নলেন গুঁড়ের স্বাদ তেমন থাকে না। শুধু রং বাদামি থাকে।
কাঁকসার বনকাটির প্রবীণ নাগরিক অনিল রায়। তিনি বলেন," আজ থেকে বছর ত্রিশ আগেও খেঁজুর রস এবং গুঁড় তৈরির সময় বাতাস মঁ মঁ করত গুঁড় আর রসের সুগন্ধে। আগের দিনের খাঁটি গুঁড় যে পাত্রে রাখা হত, তাতে ২-৩ দিন রাখার পর সুন্দর দানা নীচে বসত। তার সুস্বাদ অতুলনীয়। তবে এখন আর সেই সুগন্ধ যেমন নেই। তেমনই সেই স্বাদও পাওয়া যায় না। বেশী মুনাফার আশায় অত্যধিক মাত্রায় চিনি মেশানোয় সেই সুগন্ধ ও স্বাদ উধাও হয়ে গেছে।"
পানাগড়ের এক মহলদার জানান," আগাম বরাত দিলে খাঁটি গুড় তৈরি করা হয়। তবে পরিমানে কম করা হয়।" পশ্চিম বর্ধমান জেলা খাদ্য সুরক্ষা দফতর অবশ্য জানিয়েছে," সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে তদন্ত করে দেখা হবে।"